‘আপা আমার জামাইটা অনেক ভালো, আমার মেয়েকে কোন কাজই করতে দেয়না। মেয়ে সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে কাটায় । আর আমার ছেলের বউটাতো অসহ্য ! সারাক্ষণ আমার ছেলেটাকে খাটিয়ে মারে। আমার ছেলেটা সকাল থেকে রাত নাস্তারে,বাচ্চারে, স্কুলরে, অফিসরে করতে করতে শেষ!’
জ্বী, এই হচ্ছে ঘরে ঘরে আমাদের বাঙালি ভণ্ডামো। জ্বী , আপনি ভীষণ একচোখা, স্বার্থপর, ভণ্ড ! কিন্তু মানবতার কথা বললে আপনি তাতে অংশ নেনে এবং উহু আহা করেন। আপনি বেড়ে উঠেছেন জামাই ও বৌমাকে দুই চোখে দেখতে দেখতে।
আমি মিরপুরের অবাঙ্গালী-বিহারী উদ্বাস্তুদের সাথে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু ওই তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের বেদনা বোঝার মতো ঔদার্য আমার ছিলনা, এখনো নাই। জ্বী , আমিও আপনার মতোই। আমাদেরকে বলা হয়েছিল , এরা মানুষের মতোই , কিন্তু পরজীবী নর্দমার ক্রিমিকীটের চেয়েও তুচ্ছ। এদের জন্ম নর্দমায়, চলাফেরা নর্দমায় ও মৃত্যুও তাই । এরা আমাদের আমাদের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে, রাস্তা নোংরা করছে, পরিবেশ নষ্ট করছে ; চলার পথে এরা পড়ে থাকা দুর্গন্ধময় আবর্জনা। পারলে পাশ কাটিয়ে চলে যাও, পা মাড়িও না। আমরা তাই করেছি।
জ্বী ভাই, আপনার প্রতিবেশী কয়েক কোটি বাঙালি হিন্দু বাপ দাদার ভিটেবাড়ী ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ-কোলকাতায় ৪৭, ৬৯, ৭১ ও ৯০ থেকে ২০১৫, ১৬– দফায় দফায় গিয়ে রাস্তা ঘাট নোংরা করলে, পরিবেশ নষ্ট করলে আপনার খারাপ লাগে না । কিন্তু রোহিঙ্গা বা অবাঙালি-বিহারী দেখলে, তাদের ব্যাপারে সরকারের আহ্লাদ দেখে আপনি উষ্মা প্রকাশ করেন, ক্ষুদ্ধ হন।
জ্বী ভাই, তিন প্রজন্ম ইংল্যান্ডে থেকে তাঁদের ঘি মাখন খেয়ে খেলার সময় বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠে দৌড়ান। আপনার সাদা চামড়ার সহকর্মীর সাথে হাতাহাতি করেন। আপনার বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে দেশপ্রেম।
জ্বী ভাই, আপনি অস্ট্রেলিয়া যান, আপনি আমেরিকা যান আপনি ইটালি যান। আপনার ভাই যায়, বোন যায়, মামা-চাচা যায়। আপনি দিন গোনেন কবে আপনার বা আপনার প্রিয়জনের নাগরিকত্ব দেবে ওই দেশ। না দিলে, ওই দেশের ক্ষমতাসীন দলকে মা-বাপ তুলে গালি দেন।
২৩৯ জন সাদা-বাদামী চামড়ার লোক নিয়ে এমএইচ ৩৭০ সাগরে ডুবে গেলে আপনি আবেগে ভেসে যান, সাহায্যকারী জাহাজ ও বিমান পাঠান ।কিন্তু ঠুনকো নৌকায় মাঝ সমুদ্র পেরিয়ে মৃতপ্রায় হাজার আটেক বেঁচে থাকা মুসলমান রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের নিয়ে টিভি নিউজ দেখলে আপনি চ্যানেল চেঞ্জ করে স্টার প্লাস দেখেন।
বাঙালি নাগরের জন্য নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক।
তবু বলি, আশির দশকের কোন একটা সেমিনারে মাদার তেরেসার অসংখ্য কাজের মধ্যে একটা ছোট্ট মহতী কাজের উদাহরণ শুনেছিলাম। মহামারী আক্রান্ত জনপদে মাদার তেরেসা ও তাঁর সংগঠনের কর্মীরা। পাশাপাশি দুজন মৃতপ্রায়ের একজন ঘণ্টাখানেক বাঁচবেন। আরেকজন হয়তো মিনিট পাঁচেকে চলে যাবেন। মাদার তেরেসা এগিয়ে গেলেন বেশী মুমূর্ষুর কাছে , কোলের উপর মাথা নিয়ে পানি খাওয়ালেন। লোকটির শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পরে, পাশে থাকা কর্মী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, মা ওই লোকটা তো এমনিতেই চলে যাচ্ছিল। বরং যার বাঁচার সম্ভাবনা বেশী তাকেই কী আপনার সেবা করা উচিৎ ছিল না ?
মাদার তেরেসা উত্তর দিয়েছিলেন অনেকটা এইরকম, আমি জানি সে চলে যাচ্ছে, কিন্তু চলে যাওয়ার আগে জেনে যাক, পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা আছে !
[ প্রথম প্রকাশঃ ২১শে মে, ২০১৫ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য