বেশ কয়েকমাস আগে আমার এক জার্মান ক্রেতা-বন্ধু আমাদের দেশের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করলো।সে আমাদের বাংলাদেশের শম্বূক গতির উন্নয়ন দেখে যুগপৎ বেদনার্ত ও আনন্দিত ! সে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কিনছে গত বছর পনেরো ধরে।
বেদনার্ত এই কারণে যে গত পনেরো বছরে আমাদের রাস্তা ঘাট বিদ্যুৎ ইনফ্রাস্ট্রাকচারের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বর্ষা এলে কোন কোন কারখানায় যেতে ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ পাড়ি দিতে হয়। অপ্রতুল রাস্তা ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে পড়ে থাকতো নিত্যকার ব্যাপার। খুব তাড়াতাড়ি যে উন্নতি হবে তেমন কোন লক্ষণ ও দেখা যাচ্ছে না । কিন্তু, আমাদের বন্ধুত্বের কারণেও সে চায় আমাদের দেশের উন্নতি হোক।
আবার যেহেতু সে তৈরি পোশাক ক্রেতা, আমাদের এই ধীরগতির উন্নতিতে সে ক্রেতা হিসাবে খুশী। নিকট ভবিষ্যতে আমাদের এমন কোন উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়নি যে , যে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন সেক্টরে উন্নতি করে ফেলবে!
সীমাহীন দুর্নীতির কারণ রাজনীতির কালো টাকা বা ব্ল্যাক মানির কথা উঠলে সেও একমত পোষণ করলো। অর্থনীতিতে কালোটাকার দরকার আছে। কিন্তু সেইটা রকমফেরে ৭ থেকে স্বচ্ছ ১৩ বা ১৫% হতে পারে। আমি বললাম তোমার কোন ধারণা আছে, সরকারী হিসাবে আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকা আছে সম্ভবত: প্রায় ৪০ ভাগের উপরে বেসরকারি হিসাবে এইট সম্ভবত: ঠিক উল্টোটা ।
আমাদের এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণ কি? আমি নিজেই তাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আইনের দুর্বল শাসন ছাড়াও এক সর্বগ্রাসী নিরাপত্তা হীনতা মানুষকে অমানুষ করে তুলেছে ধীরে ধীরে । আমি যদি না থাকি , আমার সন্তানের বা পরিবারের কী হবে তা আমি জানিনা। আমি বেঁচে থাকতেই আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা নেই, আমি মারা গেলে কি হবে? নিজেকে ও পরিবারকে নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে শুরু হয় দুর্নীতি। তারপর, এটা পর্যবসিত হয় রোগে।মানুষের চাওয়ার তো শেষ নাই। অনোপার্জিত অর্থের ভাণ্ডার যখন তার সামনে উন্মোচিত হয়, অবারিত লুণ্ঠনের জবাবদিহিতা যখন থাকে না , সে হাত-পা, চুল-নখ দিয়ে চেটেপুটে খায়, খেতেই থাকে । পেট ভরে ফেটে যাওয়ার উপক্রম করলেও খেয়ে যেতেই থাকে , লুণ্ঠন আর থামে না ।
রাজনৈতিক নেতারা পর্যায়ক্রমে একেক টার্মে লুঠতরাজ করতে থাকে।
এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে তোমাদের পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটা দেশের অবদান অপরিসীম ! সে প্রথমে আমার কথা বুঝে উঠতে পারলো না।
আমি বললাম, ধরো একজন দুর্নীতি করছে। যখন তার পেট ভরে যাবে সে তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও কিছু দুর্নীতি করবে। উদ্বৃত্ত টাকা এখানকার ব্যাংকে রাখবে, কলকারখানায় ব্যয় করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি । আজ যদি সে অবৈধ অর্থ পাচার করতে না পারতো, তাহলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এই দস্যুতা থামবেই । আজ সুইস ব্যাংক না থাকলে তৃতীয় বিশ্বের সীমাহীন দুর্নীতির অনেকটা কমে যেতো।
ধরো, আমাদের কোন নেতা কয়েকশ কোটি টাকার লুণ্ঠন করলো। এখন আমাদের দেশের ব্যাংকে সে আর কতো রাখতে পারবে ? তাকে হয় দেশের মধ্যে সেই টাকা রোল অন করাতে হবে, অথবা অসদুপায়ে টাকা উপার্জনে ক্ষান্তি দিতে হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না কারণ, পশ্চিমা দেশের কিছু ব্যাংক এই তৃতীয় বিশ্বের দেশের রাজনৈতিক কালো মানুষদের অসীম পরিমাণ কালো টাকা নিরাপদে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ভারতের সরকারী হিসাবে ৫০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার কালো টাকা সুইস ব্যাংকে রাখা আছে। বেসরকারি হিসাবে ১৪০০ বিলিয়ন ডলার। (১ বিলিয়ন= ১০০০ মিলিয়ন, ১ মিলিয়ন= আট কোটি টাকা)। এইটা নেট থেকে পাওয়া। বাংলাদেশের হিসাব নখ-দন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশনের( দুদক) কাছে থাকলেও থাকতে পারে। আমি জানি না ।
সে আমার কথার কোন উত্তর বা তর্কে গেল না। হয়তো বুঝলো, মুখে মুখে সাদা চামড়ার এরা তৃতীয়বিশ্বের নীতি দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, ভেতরে ভেতরে এরা ততোটাই ভণ্ড !
প্রকাশকালঃ মার্চ ,২০১৩
সাম্প্রতিক মন্তব্য