উপলব্ধি:১৩

পরিপার্শ্বের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্ক কী রকম হওয়া উচিৎ– সেটা গত কয়েক হাজার বছর ধরে মহাপুরুষ, সাধু সন্ন্যাসী ও ধর্মগ্রন্থগুলো মৃদুভাষায় উপদেশ ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে করে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তির অবস্থান তৈরি করা থেকে শুরু করে, সম্পর্ক তৈরি করা ও সম্পর্কের লালনপালন কীভাবে করতে হয়, সেটা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে বই এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া।

জাপানে প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, মানুষের তিন রকম চেহারা থাকে। একটি চেহারা সে বাইরের পৃথিবীকে দেখায়। দ্বিতীয় চেহারাটি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আত্মীয় ও পরিবারের জন্যে। আর তৃতীয় চেহারাটা সে কাউকে দেখায় না বা দেখাতে পারে না । তৃতীয় চেহারাটিই হচ্ছে মানুষের আসল চরিত্র। মুশকিল হচ্ছে, সভ্য সমাজে মানুষ হিসাবে টিকে থাকতে হলে, প্রথম ও দ্বিতীয় চেহারাটাই প্রকাশ্য করা সম্ভব। নিজের গোপন গহীন কামনা,বাসনা, ঘৃণা, ক্রোধ, জিঘাংসা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি নিয়ে যে তৃতীয় চেহারা আছে, সেটি কোনভাবেই কারো কাছে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

আমি যা উপলব্ধি করেছি। ব্যক্তির ব্যাপারে চারপাশের লোকে কী বলল তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা এবং তাঁর পরিবারের লোকের কাছে তাঁর অবস্থান কী সেটা। বাইরের পৃথিবী একেক পরিস্থিতিতে, একেক পরিবেশে একজন মানুষকে মাঝারি মাপের , অলস মধ্যবিত্ত, ব্যর্থ, উন্নাসিক, অপরিণামদর্শী, স্ত্রৈণ, নানা অভিধায় অভিষিক্ত করলেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি, হৃদয়বৃত্তি, স্নেহ, ভালোবাসা, সহনশীলতা মিলিয়ে সে নিজে কী, সেটা সে জানে। ব্যক্তি তাঁর বাবা-মার কাছে সন্তান হিসাবে কতোখানি ভালো ; তাঁর সন্তানদের কাছে পিতা-মাতা হিসাবে কতোখানি স্নেহপ্রবণ; তাঁর স্ত্রী বা স্বামীর কাছে সে কতোখানি দায়িত্ববান –সেটা, বাইরের লোকের জাজমেন্টের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীর কাছে ঝাঁ চকচকে হয়েও পরিবারের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর হয় না।

উপলব্ধি: ১২

ধর্ম ও নৈতিকতার পারস্পরিক সম্পর্ক হাজার বছর আগে ছিল। আধুনিক পুঁজিবাদের এই যুগে ধর্ম ও নৈতিকতার পারস্পরিক কোন সম্পর্ক নেই। ধার্মিক লোক মানেই সৎ, নৈতিক, বিবেকবান, উপকারি, মহৎ লোক নয়। সংশয়ী, অজ্ঞেয়বাদী, প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী লোকেরাও অসম্ভব নৈতিক ও বিবেকবান হতে পারেন।

আমার এই উপলব্ধি পদে পদে দেখে ও ঠেকে শেখা। স্বল্প-জীবনে উপলব্ধি, নৈতিক লোক ধার্মিক হলেও হতে পারেন ; অন্য ধর্মের হতে পারেন অথবা ধর্মহীনও হতে পারে। অনেকটা ইশকুলের ক্লাস সেভেন-এইটের বিজ্ঞানশিক্ষার মতো, ‘সকল ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সকল ক্ষারক ক্ষার নহে।

মিরপুরে আমার শৈশবের বেড়ে ওঠা বিশাল একটা বাজারের পাশে।
বাড়ির পাশেই বৃহদায়তন মসজিদ, মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসা। বাজারের সব ব্যবসায়ীরা ওই মসজিদে আসতেন। ভেজাল থেকে শুরু করে, কালোবাজারি, মজুতদারি, সিন্ডিকেট ও বহুবিধ দুই নাম্বারি ধান্ধার কথা ছোটবেলা থেকেই জানতাম। জীবনের নানা চড়াই উৎরাইতে আমি অনৈতিক লোকেদের ধর্মের লেবাসে ও মুখোশে দেবদূতের চেহারায় ঘুরতে দেখেছি। মুশকিল হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ধর্মেই পার্থিব যে কোন অন্যায় করে প্রায়শ্চিত্ত ও মুচলেকা দিয়ে সর্বময় পরম-করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারটা আছে। এজন্যেই বেশিরভাগ ধার্মিকরা বছরের পর বছর অর্থলিপ্সু দুর্নীতি চালিয়ে যান । যেমন আমাদের ধর্মে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, ভণ্ডামি, দুর্নীতি, নষ্টামি যাই করেন না কেন, হজ্ব করে দুধে ধোয়া শিশুর মতো অপাপবিদ্ধ হওয়া যায়। এই অদ্ভুত চক্র দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ধার্মিক ব্যক্তিকে পুরোপুরি নৈতিক হতে দেয় না। একেবারে শেষ বয়সে এসে সে নানা অক্ষমতায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে ক্ষান্তি দেয় দুর্নীতির।

বন্ধু-মহলে যখনই ধর্ম ও নৈতিকতা নিয়ে কথা আলোচনা তর্ক, কুতর্ক চলে ; তখনই বাঙালি মুসলমানের শিখা আন্দোলনের কথা মনে আসে। যা কীনা ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হিসাবে পরিচিত। শিখা আন্দোলনের মটো ছিল: “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট – মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”

শিখা আন্দোলনের অন্যতম মোতাহের হোসেন চৌধুরী এবং তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সংস্কৃতি-কথা’ খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সীমিত-সংখ্যক পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে তাঁর প্রবন্ধের চুম্বকাংশ আবারো:

সংস্কৃতি-কথা। মোতাহের হোসেন চৌধুরী।।

ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা—সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।

ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরের আদেশে নয়, ভেতরের সূক্ষ্ণ চেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের ওপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ণ চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্ণ চেতনার অপর নাম আত্মা।

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়—উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাহ্কে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ’র উক্তি: Beware of the man whose God is in the skies—আল্লাহ্ যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে-কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাহ্কে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন-যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটি প্রথমশ্রেণির সিট রিজার্ভ করার আগ্রহে—অন্য কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।

অন্যদিকে কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে , অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না—এই তাদের ভেতরে দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই হোক কালচার নেই। কালচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ। …………..

অনেকে সংস্কারমুক্তিকেই সংস্কৃতি মনে করে, উভয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পায় না। কিন্তু তা সত্য নয়। সংস্কারমুক্তি সংস্কৃতির একটি শর্ত মাত্র। তা-ও অনিবার্য শর্ত নয়। অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। সংস্কারমুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি অসম্ভব। মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির চেয়ে কুসংস্কারও ভালো। শিশ্নোদর-পরায়ণতার মতো মন্দ সংস্কার আর কী হতে পারে? অর্থগৃধ্নতাও তাই—কিন্তু এসব মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তিরই ফল। তাই শুধু সংস্কারমুক্তির উপর আস্থা স্থাপন করে থাকা যায় না। আরও কিছু দরকার। কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ—এ-সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না। সূক্ষ্ণ জীবনের প্রতি টান সংস্কৃতির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির টান সে দিকে নয়, তা স্থূল জীবনেরই ভক্ত।

সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দর ভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা ; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে গিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা ; কাব্যপাঠের মারফতে, ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা ; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে , মহতের জীবনদানে বাঁচা ; গল্পকাহিনীর মারফতে, নরনারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা ; ভ্রমণকাহিনীর মারফতে, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা ; ইতিহাসের মারফতে মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা ; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকার বাঁচা । বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে , গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

(সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধের খণ্ডাংশ)

উপলব্ধি: ১১

শর্টকাট ক্যান কাট ইউ শর্ট (Shortcut can cut you short)।
সবকিছুতে শর্টকাট ভালো নয়। কেননা, শর্টকাট পদ্ধতি আকস্মিক কর্তন করে আপনাকে শর্টও করে দিতে পারে। আমার যে শান্তিপ্রিয় টাইপের চরিত্র ; বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, শৈশব থেকে এটা এমনিতেই আমি মেনে চলতাম। অন্যকে কনুই দিয়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রাসী মনোভাব আমার কখনই ছিল না। কোনকিছু পেতে হলে লাইনে দাঁড়াতাম, ভাগ্যে থাকলে আমার টার্ন আসতে আসতে হয়তো পেতাম, হয়তো পেতাম না। ব্যাপারটা পরিবার ও অন্তর্মুখিতা থেকেই এসেছে। তারুণ্যে পৌঁছে অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নিজের অধিকার চাইবার অভ্যাস হয়েছে।

ইতিহাসে আছে, আলেকজান্ডার দি গ্রেটের প্রয়াণের পরে টলেমি ( Ptolemy ) মিশরের শাসনকর্তা হন। সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ ইউক্লিড(Euclid)-এর গবেষণা নিয়ে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ ছিল ; কিন্তু তিনি সহজে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সম্রাট হয়েও ইউক্লিড-কে তিনি অনুরোধ করলেন সহজ কোন উপায়ে তাঁর গণিতকে আয়ত্ত করা যায় কীনা। ইউক্লিড উত্তর দিয়েছিলেন, জ্যামিতি শেখার জন্যে কোন রাজকীয় পথ নেই। (“Sire, there is no royal road to geometry.” )

সেই আদিম যুগ থেকেই অনিশ্চয়তা মানুষকে লোভী করেছে। ব্যক্তি মানুষের আদিম জৈবিক, শারীরবৃত্তীয় লোভের সঙ্গে ভোগবাদ আরও নানা উপকরণকে অপরিহার্য করে তাঁকে অধিকতর লোভী করে তুলেছে। তোমার মতো, অন্য আরেকজনের আছে, তোমার নেই কেন? আরেকজনের হচ্ছে, তোমার কেন হবে না? অন্যে পারলে তুমি কেন পারবে না ? কেন? কেন? কেন?

সত্যি কথা বলতে কী, এই সামগ্রিক পুঁজিবাদী লোভই কিন্তু সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। দিন-কয়েক আগে, বড়কন্যা আমাকে কোন একটা আলস্য নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিল। আমি বললাম, দেখ পৃথিবীতে বড়বড় আবিষ্কারের পিছনে অলস লোকেদের কৃতিত্ব। পরিশ্রম করেই যদি জীবন চালানো মেনে নিতো মানুষ, তাহলে এতো গাড়ি, ট্রেন, উড়োজাহাজ আর প্রযুক্তি তৈরি হত না। কীভাবে আরও আরামে, আরও অনায়াসে, আরও সহজে কাজ করা যায় সেটা আবিষ্কারের উদ্ভাবনী স্পৃহা আলস্য থেকেই এসেছে।

পুঁজিবাদী পৃথিবীতে কতো দ্রুত কোন কিছু অর্জন করা যায়, সেটার একটা কুৎসিত, দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা আছে। আমাদের তৃতীয় বিশ্বে নিয়তিবাদী লোকেরা, কিছু না পেলে ভাবে কপালে নেই, সর্বময় ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেয় না, ইত্যাদি। কিন্তু পশ্চিমাদেশের লোকেরা তো আর এতোটা নিয়তিবাদী নয়। সে জানে কীভাবে কোনকিছু অর্জন করতে হয়, এ জন্যেই সেসব দেশে মোটিভেশনের বই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। কীভাবে কম পরিশ্রম করে মিলিয়নার হওয়া যায়, সেটা নিয়েই বোধহয় এঁদের লক্ষাধিক বই আছে! মোটিভেশন বক্তা এবং তাঁদের অনূদিত বই বাংলাদেশেও দারুণ জনপ্রিয়

প্রযুক্তির যুগে এই দ্রুত শর্টকাটে বিখ্যাত হওয়ার লোভ প্রকটতম। সারাক্ষণ অপরিণত মস্তিষ্কের লোকের টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটা , ইউটিউব আপনাকে বিশ্বাস করাবে, যে আপনিও একটু ইচ্ছে করলেই ওঁদের মতো হতে পারবেন ; যা চান তাই অর্জন করতে পারবেন ; যেখানে খুশী যেতে পারবেন। কোটিপতি ও সফল চকচকে লোকটি হওয়া কোন ব্যাপারই না, শুধু একটু কষ্ট করে আপনাকে ‘ইচ্ছে’ করতে হবে, ‘মোটিভেটেড’ হতে হবে। এই চক্করে পড়ে মানুষ শর্টকাট খোঁজে। এই নিয়ম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের কৈশোরে বা তারুণ্যে বন্ধুদের মধ্যে যারা দ্রুত, অস্বাভাবিক বা বাঁকা-পথে কোন কিছু অর্জন করার চেষ্টা করতো, শুদ্ধ বাংলায় তাঁদের ‘চালিয়াত’ বলতাম। আরেকটু অশুদ্ধ বাংলায় ‘পাকনাদোচা’ বলতাম।

তবে নানা অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে , দ্রুত সফল কিংবা আর্থিক লাভবান হওয়ার আশায় অপ্রচলিত, অনৈতিক শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন না করাই ভালো। অতিরিক্ত লোভ ও স্বল্প সময়ে সাফল্যের আকাঙ্ক্ষায় অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছে। সবসময় শর্টকাট সাফল্য বয়ে আনেনা ; বরং তা মর্মান্তিক ব্যর্থতা কারণ হতে পারে, সেটা মাথায় রাখা ভালো। স্বাভাবিক উপায়ে ও গতিতে আপনি দ্রুত সম্পদ ও সম্পত্তির অধিকারী না হতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে সুখী হবেন।

প্রেমিক।। বুদ্ধদেব বসু। আলোচনা।।

৯১ সালে এসে হঠাৎ করে বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। ঠিক সহজবোধ্য নয় ; কিন্তু আলাদা একটা মধ্যবিত্ত মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর কবিতায়। আমাদের তখন দুর্দমনীয় অস্থির কৈশোর। পড়াশোনায় একবার ভালো করলে যা হয়, গায়ে ‘ভালছাত্র’ লেবেল লেগে গেল তো , জীবন শেষ! যদিও জানি দুইটা রচনা পড়লেই পরীক্ষায় কমন পড়বে ; তবু নিশ্ছিদ্র প্রিপারেশন, সবার আগে থাকার জন্য গুচ্ছের আরো বারো-তেরোটা রচনা পড়রে, আলাদা নোট বানাও রে , উফ !
বিদ্যালয়ের বালিকা শাখাটি রাস্তার ওই পাশে। ‘ভালছাত্র’ লেবেলধারীরা ঘুণাক্ষরেও ওমুখো হতাম না। কোনক্রমে আমাদের বালক শাখার কোন শিক্ষকের চোখে যদি পড়ে যাই, লজ্জার সীমা থাকবে না। সুতরাং সাদা পোশাকের সেই কিশোরীরা আমার চোখের আড়ালেই কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে গেল। ওই কিশোরীদের কেউ কেউ , যখন চল্লিশোর্ধ ‘ভদ্রমহিলা’আমার সঙ্গে তাঁদের নতুন করে পরিচয় হল স্কুল রি-ইউনিয়নে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে। চল্লিশোর্ধা কাউকে দেখে তো আর বলা যায় না, “ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘ এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
মূল কবিতার প্রসঙ্গে আসি। অস্থিরতা, পড়াশোনার চাপ, বাবা-মা-সমাজের এক্সপেক্টেশনে আমাদের কয়েকজনের অবস্থা চিঁড়েচ্যাপটা! একে নবযৌবনের উদ্গমে আমাদের অবস্থা নাজুক ; এর মাঝখানে চারিদিকের ওই ঐশ্বরিক স্বর্গের কিশোরীদের আমাদের সামনে দিয়ে যাতায়াত ! ‘জীবন’ যতোখানি রহস্যময়, আমারতো মনে হয় যৌবন তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী ও রহস্যময়।
বুদ্ধদেবের “প্রেমিক”কবিতাকে আমার চিরন্তন মনে হয়েছে আজ নতুন করে পড়ে। সেই সময়ে কেন ভাল লাগল? কারণ ওই অস্থির বৈপিরত্যে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করছে স্বর্গীয় কিশোরীদের অথচ সামাজিক অনুশাসন আমাকে রাখছে সেই ঐশ্বরিক অনুভূতি থেকে লক্ষ মাইল দূরে। তাই দূরে থাকার জন্য , ভেবে নিলাম নারী হোক কিশোরী হোক –“ , তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –” । ওটা ছিল একধরণের সামাজিক অবদমন। আমার চির আকাঙ্ক্ষিতকে “ আঙ্গুর ফল টক” ভেবে দূরে থাকা আর কী !
আজ বহুদিন পরে সকালে আবার সেই কবিতার মুখোমুখি। এবার পরিপূর্ণ রূপে ধরা পড়ল বুদ্ধদেবের চিরন্তন বক্তব্যকে। হায় ! আমি যতো দূরেই যাই, নারীর সেই রহস্যময়তাকে অবহেলা করার মতো ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দেয় নি। আমাকে/আমাদেরকে বার বার ফিরে আসতে হয় সেই ননীর মতো তনুর কাছে !
পুরো কবিতা অনুলিখন করার মতো ধৈর্য হচ্ছে না। প্রিয় লাইনগুলো পূনর্লিখন করছি। বাকীটা উৎসাহীদের জন্য ছবি আকারে রইল। উল্লেখ্য, কবিতার রচনাকাল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ।
“প্রেমিক।। বুদ্ধদেব বসু।”
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –
(ওগো কঙ্কাবতী)
মৃত-পীত বর্ণ তারঃ খড়ির মত সাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী –
জানি, সে কিসের মূর্তি ।নিঃশব্দ বীভৎস এক রুক্ষ অট্টহাসি-
নিদারুণ দন্তহীন বিভীষিকা ।
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে সেই কঠিন কাঠামো;
হরিণ-শিশুর মতো, করুণ আঁখির অন্তরালে
ব্যাধিগ্রস্থ উন্মাদের দুঃস্বপ্ন যেমন।
তবু ভালোবাসি।
নতুব ননীর মতো তব তনু খানি
স্পর্শিতে অগাধ সাধ, সাহস না পাই।
সিন্ধুগর্ভে ফোটে যত আশ্চর্য, কুসুম
তার মতো তব মুখ, তার পানে তাকাবার ছল
খুঁজে নাহি পাই।
মনে করি, কথা ক’ব আকুলিবিকুলি করে কত কথা রক্তের ঘুর্ণিতে;
(ওগো কঙ্কাবতী!)
বারেক তাকাই যদি তব মুখ-পানে,
পৃথিবী টলিয়া ওঠে, কথাগুলি কোথায় হারায়,
খুঁজে নাহি পাই।
দুর থেকে দেখে তাই ফিরে যাই; (যদি কাছে আসি, তব রুপ অটুট রবে কি?)
ফিরে চলে যাই।
দুর থেকে ভালোবাসি দেহখানি তব-
রাতের ধূসর মাঠে নিরিবিলি বটের পাতারা
টিপটাপ শিশিরের ঝরাটুকু
যেমন নীরবে ভালোবাসে।
________________________
জানি, তুমি ভুলে যাবে সে-উৎকন্ঠা সে- বেদনা, সেই ভালেবাসা
প্রথম শিশুর জন্মদিনে।
তোমার যে-স্তনরেখা বঙ্কিম, মসৃণ, ক্ষীণ, সততস্পন্দিত-
দেখেছি অস্পষ্টতম আমি শুধু আভাস যাহার,
যাহার ঈষৎ স্পর্শ আনন্দে করেছে মোরে উন্মাদ- উন্মাদ,
জানি, তাহা স্ফীত হবে সদ্যেজাত অধরের শোষণ-তিয়াষে।
আমারে করিতে, মুগ্ধ যে- সুসুগ্ধি সুষমায় আপনারে সাজাতে সর্বদা,
তোমার যে- সৌন্দর্যরে ভালোবাসি (তোমারে তো নয়!),
জানি, তা ফেলিয়া দেবে অঙ্গ হতে টেনে-
কারণ, তখন তব জীবনের ছাঁচ
চিরতরে গড়া হয়ে গেছে;
কিছুতেই হবে নাকো তার আর কোনো ব্যতিক্রম।
________________________
তোমার বাদামি চোখ- চকচকে, হালকা, চটুল
তাই ভালোবাসি।
তোমার লালচে চুল –এলোমেলো , শুকনো , নরম
তাই ভালোবাসি।
সেই চুল, সেই চোখ, তাহারা আমার কাছে অরণ্য গভীর,
সেথা আমি পথ খুঁজে নাহি পাই,
নিজেরে হারায়ে ফেলি সেই চোখে, সেই চুলে- লালচে বাদামি,
নিজের ভুলিয়া যাই, আমারে হারাই-
তাই ভালোবাসি।
আর আমি ভালোবাসি নতুন ননীর মতো তনুলতা তব,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
আর আমি ভালোবাসি তোমার বাসনা মোরে ভালোবাসিবার,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
ওগো কঙ্কাবতী!
[ প্রথম প্রকাশ ১৪ই নভেম্বর ২০১৬]