উপলব্ধি: ১৮

সামাজিক ও জীবিকার শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও মানুষের একটি ইন্টেলেকচুয়াল, বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনাচরণ থাকা দরকার। জীবনের নানা পর্যায়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। শৈশব থেকে শুরু করে এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও আমাদের সঙ্গে নানা আলোচনা হয়। স্যার আমাদের (তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ) অনেকের সীমাবদ্ধতা বোঝেন। সামাজিক চাপে , জীবিকার কাছে আমাদের নতিস্বীকারের দুর্বোধ্য বেদনাও বোঝেন। তারপরেও তিনি আমাদের সবসময় বলতেন, যে জীবিকাতেই আমরা থাকি না কেন , আমাদের একটা বুদ্ধিবৃত্তিক, সংবেদনশীল জীবন থাকা দরকার ; সম্পন্ন জীবনবোধ থাকা দরকার। কেউ যদি দিনের পর দিন কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে তার মন শুকিয়ে যায়।

স্যার বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত, উদ্বুদ্ধ করেছেন সারাজীবন। ব্যস্ত, ঊর্ধ্বশ্বাস এই জীবনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাদেরকে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে বলতেন। মানুষ প্রকৃতির কোল থেকে উঠে এসেছে। আমাদের আদি ও অকৃত্রিম প্রবণতা হচ্ছে আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া স্বস্তি-বোধ করা। এবং আমরা প্রকৃতির কাছে গেলেই সবচেয়ে সজীব, প্রাণবন্ত ,উৎফুল্ল হয়ে উঠি।

উপলব্ধি: ১৭

নিরাপত্তাহীনতা বা ইনসিকিউরিটি !
জীবনের সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অনুভূতি হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা । সীমিত আকারে থাকা ভালো। বেশি নয়। আপনার আসল নিরাপত্তা-বোধ আপনার নিজের কাছে, আপনার প্রিয়জন ও পরিবারের কাছে। অসীম পরিমাণ অর্থকড়ি থাকলেও সেটা আপনার জীবনকে নিরাপত্তার স্বস্তি দেবে না।

যে নিরাপত্তাহীনতায় আমাদের মধ্যবিত্ত অগ্রজরা ভুগেছিলেন ; তা আমাদের মাঝে বংশানুক্রমে চলে আসে। বিদ্যা-শিক্ষা, উপার্জন, পরিশ্রম, প্রতিযোগিতায় নানারকম প্রাপ্তি ও অর্জন দিয়ে জীবনের অর্ধেক সময় ব্যয় করে আমরা নিজেদেরকে নিরাপদ করার চেষ্টা করি । শিক্ষা, চাকরি,ব্যবসা ,টাকা, গাড়ী, বাড়ি, শেষ-বয়সের জন্যে সেভিংস ইত্যাদি ইত্যাদি। মূলত: এর কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ বা সীমারেখা তো নেই। মাথাগোঁজার একখানি জমি হলে কি মানুষ নিরাপদ ? সে কী ক্রমাগত আরও জমির মালিক হতে চায় না ! একটা ফ্ল্যাট হলে আরেকটা করে নিরাপত্তা পোক্ত করতে চায়। নগরীর এই প্রান্তে কিছু থাকলে, ঐ প্রান্তে । ব্যক্তি লাখ টাকার ব্যাংক ডিপোজিট যেমন নিরাপত্তাহীন থাকে ; কোটি টাকা ডিপোজিটেও তাই।

কোন কিছু দিয়েই আমরা নিজেদেরকে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ করতে পারিনা বা নিরাপদ ভাবতে পারিনা। পরবর্তী বংশধরদেরকেও একই ভাবে নিরাপদ করার ক্রমাগত চেষ্টা করে যাই। স্বদেশ থেকে দূর পরবাসে প্রবাসী হয়ে জীবনকে আরও নিরাপদ করতে চাই। একটা ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় ক্রমাগত আমাদের ত্রস্ত করে, ক্লান্ত করে। আর এই অসাধারণ জীবন আমাদের হাতের ফাঁক গলে কখন যে নীচে পড়ে যায় , আমরা টেরও পাইনা ! নিরাপত্তার প্রস্তুতি নিতে নিতে জীবন শেষ হয়ে যায় !

উপলব্ধি: ১৬

অনিশ্চয়তা বা আনসারটেইনিটি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। যতক্ষণ বেঁচে আছেন, আপনার সমস্যা থাকবে এবং অনিশ্চয়তা থাকবে। আমরা কেউই জানিনা – আগামীকাল কী হবে, আগামী সপ্তাহে বা বছরে কী হবে! আমরা ভুলে যাই, পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে শুরু করে থেকে আমার মত সাধারণ লোকের জন্য এই অনিশ্চয়তা সমানুপাতিক-ভাবে আছে। এই অজানা অনিশ্চয়তাকে ঘিরেই আমাদের বৈচিত্র্যময় লৌকিকতা , আচার-আচরণ,ধর্ম ও সামাজিকতা গড়ে ওঠে। আমরা একেকজন একেকভাবে জীবনকে দেখা শুরু করি। কীভাবে জীবনকে দেখতে হবে আমরা অন্যের কাছ থেকে শিখে ফেলি বা অনুকরণ করা শুরু করি। প্রচলিত পথেই অনিশ্চয়তাকে কাটাতে চেষ্টা করি। কিন্তু পেরে উঠি না। অনিশ্চয়তাকে যে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না, এটাও মেনে নিতে পারি না। তাই, পরিমিত অনিশ্চয়তা শরীর ও মনের জন্য ভালো ; অতিরিক্ত অনিশ্চয়তা বাড়াবে অনর্থক হতাশা ও উদ্বেগ, সেটি শরীর-মন কোনটির জন্যেই ভাল নয়।

 

উপলব্ধি: ১৫

কৌতূহলী হন, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা ধরে রাখুন, চর্চা করুন। কীভাবে বিস্মিত হতে হয়, সেটা প্রতিনিয়ত চর্চায় রাখার জন্যে শিশুদের সঙ্গে অথবা নিজের চেয়ে কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে মেলামেশা করুন, যোগাযোগ রাখুন। সমবয়সী অথবা বয়স্ক লোকেরা অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন না ; একঘেয়েমিতে ক্লান্ত হয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্বের পাশাপাশি সবুজ, কাঁচা তারুণ্যের সাহচর্যে থাকুন।

উপলব্ধি: ১৪

যে কোন বয়সে, যে কোন অবস্থায় এক বা একাধিক বন্ধু থাকা আবশ্যক কিংবা এক বা একাধিক বন্ধু খুঁজে নেওয়া উচিৎ, যার বা যাঁদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা যায়। অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে শুরু করে নিজের যৌন ব্যর্থতা অবধি। বিষয়-ভেদে শেয়ার করার জন্য কয়েকজন হলেও ভালো। মনের কথা খুলে বলার জায়গা দরকার। যদি কাউকে না পান, কেউ না থাকে, ডায়েরিতে লিখে রাখুন।

স্কুল জীবনে একাকী, অসহ্য নিঃসঙ্গতায় নিজের মনে কথা খুলে বলার জন্য দিনলিপি বা ডায়েরিই ছিল আমার বড় ভরসা। কতশত অবসাদ, ক্লান্তি, ক্লেদ জমে থাকে মানুষের মনে! মন খুলে বলতে পারলে বা লিখে ফেললে মনের বিষণ্ণতা কেটে যায়। নিজেকে ভারহীন মনে হয়।

তবে, এ ব্যাপারে সাবধানতা হচ্ছে এই— যে নিজের ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, সাফল্য ব্যর্থতা, শক্তিমত্তা, দুর্বলতা বন্ধু-মহলের অথবা পরিবারের এমন কারো সঙ্গে অথবা কর্মক্ষেত্রে এমন কোন সহকর্মীর সঙ্গে করবেন না, যিনি কীনা পরবর্তীতে নিজের সুবিধার জন্য আপনার আবেগ অন্যের কাছে তথ্য হিসাবে বিক্রি করবে অথবা আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারে। আমার জীবনে এরকমটি হয়েছে কয়েকবার।