উপলব্ধি: ৪৩

জীবনে থামতে জানতে হয়। মানবজীবন যেন এক ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়। কখন কোথায় থামতে হবে সেটা বোঝা জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের পথচলা কখন শুরু হয়ে যায় সেটা আমাদের হাতে থাকে না অনেকাংশে। কিন্তু থামতে পারাটা আমাদের হাতেই থাকে। আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা রাজকুমার হিরানির ‘থ্রি ইডিয়টস’। তো হিরানি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,“ প্রত্যেকের বোঝা উচিত, ‘প্রয়োজন’ ও ‘লোভের’ মধ্যে পার্থক্য কী। আপনার জানা উচিত, ঠিক কোন জায়গাতে আপনাকে থামতে হবে এবং এটাও জানা উচিত, ‘আর নয়, অনেক হয়েছে’ কথাটা কখন বলতে হবে। অনিশ্চয়তা আপনাকে শেষ করে দিচ্ছে? পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির দিকে তাকান, তিনিও বলবেন, ভয় লাগে, কখন সব শেষ হয়ে যায়! আপনি যদি এই অনিশ্চয়তার ভয় কাটাতে পারেন, তবে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।”
এই থামতে পারার ব্যাপারটা যখন আমি খুব চাপে থাকি, তখন নতুন করে বোঝার চেষ্টা করি ও থামি।

উপলব্ধি: ৪২

The biggest invention of 20th century is– if you change your perspective, your life will be changed.

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, আমার ইংরেজি ভোকাবুলারির অবস্থা ছিল তথৈবচ। তো আমার সবসময়ের পথপ্রদর্শক সিনিয়র ভাই বললেন, ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ হতে হলে, মুরব্বীদের গতানুগতিক উপদেশমতো ভুলেও বাংলাদেশের ইংরেজি পত্রিকা যেন না পড়ি। ওখানে বৃদ্ধ লোল-চর্মসার কিছু সম্পাদক পুরনো, অপ্রচলিত ও বাতিল শব্দমালা দিয়ে সম্পাদকীয় লেখেন। সেটা পড়ে বুঝতে গেলে সামনে ডিকশনারি নিয়ে বসতে হয়। ইংরেজির প্রতি উল্টো বিতৃষ্ণা আসবে। আমাকে উনি নীলক্ষেত থেকে পুরনো ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ কিনে পড়তে বললেন। একই সঙ্গে Mills and Boon নামের এক প্রকাশনীর গল্পের বইগুলো নাড়াচাড়া করতে বললেন। তো, রিডার্স ডাইজেস্টের এক প্রবন্ধে সেই ৮৭ সালে আমি একটা প্রবন্ধে পড়লাম, Change your perspective your life will be changed.

বহু বহুবছর পরে এই কার্যকর জনপ্রিয় দর্শনটি , ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে জীবন বদলাবে’– ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ এর মূল শ্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখলাম। যে যেই অবস্থায় থাকুক না কেন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলে, তাঁর জীবন কিছুটা হলেও বদলে যায়। কে না জানে , একই শহরের দুই পথচারীর গন্তব্য আলাদা থাকে। আর একই দৃশ্যপটে দুই ব্যক্তির দুই রকম প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক।

উপলব্ধি: ৪১

আত্মবিশ্বাস জরুরী। একই সঙ্গে নিজের সক্ষমতা, শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা বোঝাটাও জরুরী। বাইরের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য নিজের মন সবচেয়ে বড় সহায় । আমার মনে হয়েছে, পরিপার্শ্বের ব্যাপারে কিছুটা ভাণ করে হলেও আশাবাদী থাকা উচিৎ। এটা শুনতে কিছুটা ফ্যান্টাসির মতো মনে হতে পারে। কিন্তু অনর্থক দুশ্চিন্তা করার চেয়ে অলীক আশাবাদ অনেক ভাল। কেননা, ঐ আশাবাদ আপনার সমস্ত আচার আচরণ, মনোভাব কে এমনভাবে প্রভাবিত করবে যে, আখেরে সেটা আপনার জন্য ভাল ফল বয়ে আনবে। খেয়াল করে দেখুন, হাজার বছর ধরে ও আধুনিক কালেও বেশিরভাগ মোটিভেশনাল স্পিকার এই ভাণ করার কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে বলে। যে কোন পরিস্থিতিতে, কেউ যদি নিজেকে বিশ্বাস না করে তবে অন্যেরা কীভাবে তাকে বিশ্বাস করবে ! কেউ যদি ত্রস্ত এলোমেলো পায়ে চলে, তাকে অনুসরণ করবে কে ! কেউ যদি ভাণ করেও আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে চলে, তবে আরেক পথভোলা তাঁকে অনুসরণ করলেও করতে পারে।

উপলব্ধি: ৪০

যাপিত জীবন ও যৎসামান্য পড়াশোনায় আমার একটা উপলব্ধি হয়েছে: প্রকৃতি ধনী-গরীব নির্বিশেষে দুইটি জায়গায় কাউকেই বঞ্চিত করে নাই। একটা অসাধারণ সাম্যাবস্থা আছে সেই প্রকৃতির সেই দানে , সবাই সেখানে সমান । দুইটি প্রকৃতি-প্রদত্ত দান হচ্ছে খাদ্যগ্রহণ ও যৌনতা। খাদ্য গ্রহণ ও যৌনতায় সকলের জন্যে পরিপূর্ণ তৃপ্তি আছে। অন্য কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য প্রকৃতি রাখেনি। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি , খাদ্য, পানীয় নিয়ে অবলীলায় আমরা কথা বলি। ভোগ উপভোগের তুলনা করি। কী খাওয়া উচিৎ, কেন খাওয়া উচিৎ, কীভাবে খাওয়া উচিৎ, তা নিয়ে আমাদের বহু কথা হয়। অথচ সেই প্রেক্ষিতে যৌনতা নিয়ে আমাদের কোন কথা হয় না । যৌনতাকে নিষিদ্ধ, ট্যাবু ভেবে নানা ভুল ধারণা নিয়ে না থেকে সেটা নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ । আমি ব্যক্তিগতভাবে তাই মনে করি। কেউ ধর্মীয় বিধিনিষেধের কথা তুলতে পারেন। তবুও আমি বিশ্বাস করি, খোলামেলা আলোচনা ভাল।

উপলব্ধি: ৩৯

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রায়শ: একটা কথা বলতেন, ‘অর্থহীন বেদনার কোন অর্থ নাই!’ আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ আসে জীবনে। বিষণ্ণতা আছে, আছে হতাশার কাল। জীবনযাপনের ক্লান্তি আছে! জীবনের ক্ষয় আছে, গতিহীনতা আছে, বাঁধা আছে, ক্লেদ আছে। ওই যে হয় না, মেশিন চললে শুধু প্রোডাক্টই হয় না, তাতে অবধারিতভাবে ধুলো জমে, জং ধরে, গতি কমে যায় আর সাথে সাথে কিছু উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট তৈরি হয়। উপভোগ্য জীবনে সারাক্ষণ প্রাপ্তির পাশে দুই একটা অপ্রাপ্তি সবারই আছে । সকাল থেকে রাত্রি, প্রাতঃকৃত্য, খাওয়া, হেঁটে চলে কর্মস্থলে আসা– গোটা তিরিশেক কাজতো ঠিকমতোই হচ্ছে ; এর মাঝে ছোটবড় কোন কাজে বাধা আসতে পারে, আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতা থাকতেই পারে, সেটাকে বড়ো করে না দেখলেই হয় !
বহু বছর আগে এক দক্ষিণভারতীয় সহকর্মীর নোটবুকে লেখা ছিল, It doesn’t matter how many times you fall down, all that matters how quickly you are bounced back. মূলত: বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি জীবনে অবধারিত। কিন্তু আমাদের চেষ্টা থাকা উচিৎ কতো দ্রুত সেটা থেকে আমরা বের হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনের ফিরে আসতে পারি।

কেন ডিপ্রেশন?
কারণ আপনি একটা কিছু হোক চেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে না বা করতে পারছেন না। একটা বাঁধা , একটা অবস্টাকল আপনাকে বিষণ্ণ করবে। হতাশ করবে।
কিন্তু এটাও তো সত্যি, যে অনেক কিছু হচ্ছে। সারাদিন এই অফিস, গাড়ীতে চলা, খাওয়া, বাচ্চাদের চেহারার আনন্দ, ভালোবাসা, সব তো হচ্ছে। এই নিঃশ্বাস এই বেঁচে থাকা আশ্চর্য নয়, এখানে হতাশা কোথায়? বিষণ্ণতা কোথায়?
স্যার কথাগুলো ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন।
এই যে, সারাদিন আমাদের ২০টা কাজ হচ্ছে, তার ১৯টা কাজই তো সাফল্য। সকালে ওঠা, নাস্তা করা, অফিসে আসা, সমস্ত দায়িত্ব পালন করা, সব। হ্যাঁ, সারাদিনে একটা কাজে হয়তো আপনি ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই বলে সমস্ত দিনটা তো আর ব্যর্থ নয়! জীবনের বেশিরভাগ তাই সাফল্যের, আশাবাদের, ভালোবাসার, আনন্দের।