উপলব্ধি: ২৮

অফিস মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরবেন না।

আমার প্রাথমিক কর্মজীবন ছিল টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে শিফটিং ডিউটির ।
এ,বি,সি শিফট। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা ; দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা আর সি শিফট হচ্ছে রাত দশটা থেকে ভোর ৬টা।
আমি যখন শিফটের গাড়ি ধরতে অন্ধকার কাক-ডাকা ভোরে বাসা থেকে বের হতাম, তখন মহল্লার সবাই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
শিফটিং ডিউটির সময় মনে হতো আমি সারাক্ষণ কাজের ভিতরে আছি। সারারাত নির্ঘুম কেটে দিনের বেলায় গড়াগড়ি দিয়ে আবার শিফট ধরতে ধরতে মনে হতো, আমি লেখক হুমায়ূন আহমদের ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’ নামের এক উপন্যাসের অসীম চক্রে পড়ে গেছি। দিনরাত একাকার। কারখানার ডরমিটরিতে থেকে ডিউটি দিতে আরো অসহনীয় লাগত। বরং বাসায় ফিরে এলে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নিজের বিছানা, আপনজন আর পরিচিত মহল্লা দেখে মনে হতো আমি বিশ্রামে আছি। শিফটিং ডিউটির একটা সুবিধা ছিল, শিফট বুঝিয়ে দিয়ে আসলে তেমন কোন দুশ্চিন্তা থাকতো না।

প্রোডাকশন থেকে যখন সেলস, মার্কেটিং, মার্চেন্ডাইজিং এ চলে আসলাম, কাজের ধরণটা এমন যে, এখানেও সারাক্ষণ মনে হতো অফিস করছি।
মোবাইল প্রযুক্তি আসার পরে আমি একসময় তিক্তবিরক্ত হয়ে গেলাম। দিনরাত২৪ ঘণ্টাই আমাকে ফোনের উপরে থাকতে হতো।

আমি যখন Mothercare Sourcing BD-তে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা শুরু করলাম, তখন আমাদের ৭ সোর্সিং ম্যানেজারকে আমাদের ডিরেক্টর একটা করে ব্ল্যাকবেরি দিলেন।সবাই ভীষণ খুশি। শুধু আমি ব্ল্যাকবেরি নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। সে অবাক হলো। কারণ তখন ব্ল্যাকবেরি ছিল দারুণ সম্মান ও ফ্যাশনের একটা জিনিস। যার হাতে ব্ল্যাকবেরি সে যে হোমরাচোমরা বোঝা যেত। যাই হোক, আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম,দেখো আমি সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি ইমেইল আর ফোনে থাকি। বাসায় যখন ফিরি তখন অতি-জরুরি কিছু ছাড়া দাপ্তরিক কাজগুলোর ঝামেলা নিতে চাচ্ছি না। এতে করে বরং আমার প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আমার প্রথম কন্যা সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে; বাসায় ফিরে আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকি ওঁকে নিয়ে। ঐ যে আমার অভ্যাস হয়ে গেল, বাসায় ইমেইল কিংবা দাপ্তরিক কাজ না নিয়ে যাওয়ার, সেটা গত ১৬ বছরে একই রকম আছে।

এই ডিজিটাল যুগে সারাক্ষণ ইমেইল না দেখে সাময়িকভাবে কর্মক্ষেত্রে কিছুটা পজিশন ও পারফরমেন্সের ক্ষতি হয়েছে,অন্য সহকর্মীদের মতো আপডেট থাকতে পারিনি।
তবে আমার মনে হয়েছে আখেরে লাভ হয়েছে আমার ও আমার পরিবারের।

উপলব্ধি: ২৭

মানুষকে বিশ্বাস করুন ; সামান্য দ্বিধা ও সঙ্কোচ নিয়েই করুন।
অসঙ্কোচ বিশ্বাসে আপনি ঠকে গেলে বড় ধরণের ধাক্কা খাবেন, হয়তো ভেঙ্গে পড়বেন, উঠে দাঁড়ানো মুশকিল হবে। আমার কাছে মনে হয়, বিশ্বাস করতে হলে, নিজের ভিতরে কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে করাই উত্তম।

একটা উদাহরণ দিই।
শহর ঢাকার অগণিত ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষুকদের বিশ্বাসযোগ্যতা নাই। শহরের অর্ধেক ভিক্ষুক সত্যিকারের ভিক্ষুক নাকি, পরিযায়ী, ভ্রাম্যমাণ, অলস, অকর্মণ্য, ধান্ধাবাজ –সে ব্যাপারে সকলেরই সন্দেহ আছে। রাস্তার ভিক্ষুকদেরকে ভিক্ষা দিতে আমার
নিজেরও অনীহা আছে। এরা এমনভাবে আপনাকে বেহেশতের লোভ দেখাবে অথবা দোজখের ভয় দেখাবে যে, সেই লোভেই হোক বা ভয়েই হোক আপনি ভিক্ষা দিয়ে পরকাল সামলাবেন। কোন কারণে, ভিক্ষা দিতে আপনি অস্বীকৃতি জানালে, আপনাকে ক্রমাগত বিরক্ত করতে থাকবে, আপনার গাড়ি ধাক্কা দেবে, অভিসম্পাত করতে থাকবে।

আমি পারতপক্ষে রাস্তার ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিই না ; আবার কাউকে ভিক্ষা দিলেও চিন্তা করিনা, ‘সত্যিকারের’ ভিক্ষুক কীনা। সেই একইভাবে , অনেকেই নানা সময়ে ছোট অংকের ধার চেয়েছে, যেটা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাঁদেরকে সাহায্য বা ধার দিলেও ধরে নিয়েছি, সেটা আর কখনো ফেরত পাব না। ফেরত পেলে খুশী হয়েছি। তাঁদের সঙ্গেই বড় অংকের আর্থিক লেনদেনে গেছি, যাঁদেরকে দীর্ঘদিন ধরে আমি চিনি।

উপলব্ধি: ২৬

নিজেকে মেনে নিতে শিখুন, নিজেকে ক্ষমা করতে শিখুন। নিজেকে ক্ষমা করতে পারা ও নিজেকে মেনে নিতে পারার সক্ষমতা হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসতে শেখা। সারাক্ষণ নিজেকে দোষারোপ করবেন না। সেলফ-টক বা নিজের সঙ্গে নিজে যখন কথা বলছেন, যা ঘটে গেছে, সেটার জন্যে নিজেকে সার্বিক দোষী ভাববেন না। নিজেকে সুযোগ দিন।

উপলব্ধি: ২৫

টানেলের দুইদিক থেকেই দেখার চেষ্টা করুন। আমাদের ধর্মে ও ইতিহাসে ঘুরে ফিরে এই কথা বহুবার বলা হয়েছে, ব্যক্তির আচরণ বুঝতে হলে, আপনি নিজে তাঁর অবস্থানে কী করতেন সেটা একবার হলেও উপলব্ধি করার।
কোন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি কী ধরণের আচরণ করতে পারে সেটা ঐ ব্যক্তির অবস্থানে নিজেকে চিন্তা না করতে পারলে বোঝা যায় না। কল্পনাশক্তির ব্যবহার করুন, নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে বোঝার চেষ্টা করুন, নির্দিষ্ট ব্যক্তি একটি পরিস্থিতিতে কেন ওইরকম আচরণ করল।

এই ব্যাপারটা চর্চা করতে পারলে, নিজেকে চরমভাবাপন্ন হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই চর্চা যদি শৈশব থেকে আমাদের প্রজন্মের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া যেতো, আমাদের সমাজ অনেক বেশি সহনীয় হত।

ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত দেখি। যদিও প্রথম বাক্যটি একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতার , যাতে মাতৃ-স্বার্থের গন্ধ আছে। তারপরেও গান্ধারীর মুখনিঃসৃত এই চরণ গত শতাব্দীতে বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় হয়েছে।
“…প্রভু, দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে-বিচার। যার তরে প্রাণ
কোনো ব্যথা নাহি পায় তারে দণ্ডদান
প্রবলের অত্যাচার। ”
(গান্ধারীর আবেদন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।)

আবার কিছুটা হলেও সংঘাত তৈরি করে তাঁর আরেকটি উক্তি। এই উক্তিও বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের নিখিলেশের স্বগতোক্তি। “ যে দুর্বল সে সুবিচার করতে সাহস করে না,— ন্যায়পরতার দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যায়ের দ্বারা সে তাড়াতাড়ি ফল পেতে চায়। ”

যতই বলি না কেন, জাজমেন্টাল না হওয়াই উত্তম। কিন্তু সেটা আর পারি কোথায় !
আপনি ক্ষমতাবান হন, দুর্বল হন, ক্ষমতালিপ্সু হন, ঊর্ধ্বতন হন—আপনাকে প্রতিদিন এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতেই হয়। তাই, বিচারের রায় বা সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলার আগে একটু সময় নিন।

উপলব্ধি: ২৪

কর্মজীবনে যদি ঊর্ধ্বতনের কাছে প্রয়োজনীয় কিছু চাইতে হলে, বলতে হলে — ভণিতা না করে , সরাসরি বলে ফেলার চেষ্টা করুন। আমি সেটা শিখেছি অনেক পরে। আমি মূলত অন্তর্মুখী। নিজের প্রয়োজনের কথা অনেক সময় বলে ফেলতে দেরি করেছি। অথবা এড়িয়ে গেছি। অনেক পরে এসে বুঝেছি, নিজের কথা অন্যকে দিয়ে বলানোর চেয়ে নিজে বলে ফেলাই ভাল। তবে, এই বলার ব্যাপারটাও সঠিক সময়ে হতে হবে। ভুল সময় হলে মুশকিল, হিতে বিপরীত হতে পারে।