উপলব্ধি: ৩৩

অবসরজীবন নিয়ে চিন্তা।
কর্মক্লান্তিতে একসময় শুধু বিশ্রামের কথা ও সদর্থে রিটায়ারমেন্টের কথা চিন্তা করতাম।
মনে হতো সব সুখ বোধহয় নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রামে। কাজে ব্যস্ত থাকা মানেই কামলা শ্রেণির লোক। পৃথিবীতে যে যতো সম্পদশালী, তাঁর ততো বেশি অবসর আর বিশ্রাম।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটা বয়সে এসে বুঝেছি, রিটায়ারমেন্টের দিকে ধাবিত হওয়া মানে নিজেকে সমাজের কাছে মূল্যহীন করার চিন্তা করা। বরং নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলেই মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা থাকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের ভিতরে থেকে নিজেকে মূল্যবান মনে করতে চাওয়াটাই শ্রেয়।

মধ্যবিত্তের রিটায়ারমেন্ট মানে– পুরোপুরি অপাঙতেয় মূল্যহীন জীবন। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। আমাদের সমাজে অবসর নেওয়া সুস্থ ব্যক্তিটির সামনে দুইটা রাস্তা খোলা থাকে– কবরস্থান আর মসজিদ। এঁরা তসবিহ্ নিয়া মসজিদে যাওয়া আসা করে আর এবং সারাক্ষণ সাড়ে তিনহাত অন্ধকার কবরের কথা চিন্তা করে। সারাক্ষণ মৃত্যু-চিন্তায় মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়। কাজ নেই , আলো নেই, বাতাস নেই, হাসি নেই, দুরারোগ্য সার্বক্ষণিক মৃত্যুর দুশ্চিন্তায় কে না বুড়িয়ে যায় !

গতানুগতিক বাঙালীরা চল্লিশ পেরুতে না পেরুতেই অবসর জীবনের চিন্তা শুরু করে। আমাদের দুই প্রজন্ম আগে ত্রিশ পেরুলেই এই চিন্তা আসতো আর চল্লিশ পেরুলে হজ্জ্ব সেরে তসবীহ্ গুনত। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কিছুটা সুবিধা পাচ্ছি আমরা।

এর চেয়ে বরং একটা স্মৃতি রোমন্থন করি।
প্রায় একযুগ আগে, চীনা বংশোদ্ভূত এক ক্রেতা, যিনি কিনা দ্বিতীয় প্রজন্মের আমেরিকান, তার সাথে কথা হচ্ছিল। বয়স প্রায় ৬৫ হবে। সে কোম্পানির এমডি, সর্বেসর্বা।

টাকা পয়সা পরিশোধ নিয়ে ঢিলেমির জন্য আমি এক পর্যায়ে বললাম, ‘কাহিনী কি ? এইটা ঝুলিয়ে রাখার মানে কি ? তুমি মালিক, তুমি বললেই তো হয়ে যায় ! ’

সে বলল, ‘আমার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে আবার কে? তার কথাতো আগে বলো নাই।’
‘উনি আমার বাবা।’
‘বয়স কতো ?’
‘৮৯ বছর !’
‘এই বয়সে সে অফিস করে ! ’
‘না, সেই অর্থে অফিস করে না ! তিনি প্রতিদিন নিয়মিত সকাল আটটায় অফিসে আসেন ঘড়ি ধরে। আমি তাঁর ব্যবসার উত্তরসূরি ; আমার অফিসের ফিন্যান্সটা এখনো উনিই দেখেন। মাঝে মাঝে দুপুরের পরেও থাকেন , নইলে বাড়ী যেয়ে বা এলাকার চ্যারিটি কিছু সংস্থা আছে সেখানে সময় কাটান !’

‘উরি বাপস্ , বলো কি তুমি !’

আমার বিস্ময় প্রকাশে সে বলল, ‘ তোমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে আমাদের এটা একটা বড়ো মানসিক পার্থক্য। তোমরা তীব্রভাবে পরকালে বিশ্বাসী। আমরা নই। আমরা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের ভিতরে থেকে নিজেকে মূল্যবান মনে করতে চাই।’

চল্লিশ পেরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। বড়ো কোন অসুস্থতায় না পড়লে, যতদিন পারি কাজের ভিতর থাকব। সেই কাজ অর্থকরী হোক বা সমাজকল্যাণমূলক হোক। মরার আগে মরতে চাই না। অপাঙতেয় মূল্যহীন জীবন চাই না ।

উপলব্ধি: ৩২

কথা শুনুন, ভালো শ্রোতা বিলুপ্তপ্রায়। মনো-বৈজ্ঞানিকরা বহুবছর ধরেই মাল্টিটাস্কিং করতে অনুৎসাহিত করছেন। কেননা, কেউ যদি সত্যিকার মনোযোগ দিয়ে কারো কথা শোনে, তবে তাঁর পক্ষে অন্য কাজ করা সম্ভব নয়। গ্রিক দার্শনিক Epictetus সেই হাজার দুয়েক বছর আগেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন –‘We have two ears and one mouth so that we can listen twice as much as we speak.’

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সবার কাছে লক্ষ লক্ষ অভাবিত তথ্য, নিজেকে প্রকাশিত করার অভিনব সব সামাজিক মাধ্যম। সবাই বলতেই চায়, দেখাতেই চায়, কেউ হৃদয় দিয়ে, একটু সময় নিয়ে কারো কথা শুনতে চায় না। বক্তার তুলনায় শ্রোতা আশঙ্কাজনক-ভাবে কম।

যতদূর বুঝতে পেরেছি, আমি শ্রোতা হিসাবে ভালো। আমি অনেকের প্রিয়ভাজন নই সেটা যেমন সত্য, তেমনি অনেকে আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন তার কারণ আমি মন দিয়ে কথা শুনি। শর্ত প্রযোজ্য: তাঁদের কথাই মন দিয়ে শুনি যাঁদের কথা মিনিমাম লেভেলের শ্রাব্য।

কাউকে জানতে হলে, কারো কাছাকাছি হতে হলে, তাঁর কথা মন দিয়ে কথা শুনুন।
কারো ব্যর্থতার গল্প, বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, হেরে যাওয়ার গল্প, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার গল্প। শুনুন মন দিয়ে শুনুন।
সিনেমার পর্দায় নয়, আমাদের জীবনের গল্পের নায়ক-নায়িকারা আমাদের চারপাশেই আছেন।

উপলব্ধি: ৩১

কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের একদম শতভাগ বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই যেমন Gut Feelings এর সঠিক বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না। অন্তর্দৃষ্টি, অবচেতন, প্রজ্ঞা, বোধ অনেককিছুই হতে পারে। ব্যাপারটা এমন যে, কোন কোন সিদ্ধান্ত মানুষ যুক্তি তর্কের বাইরে গিয়ে তাঁর সহজাত অনুভূতি থেকে নিয়ে থাকে। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই নিজের গাট ফিলিংস ( Gut Feelings) কে গুরুত্ব দিতে হয়।

হয়েছে কী, কয়েকশ বছর আগের একজন সাধারণ মানুষ সারাদিনে যে পরিমাণ সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁর চেয়ে এখন কয়েক হাজারগুণ বেশি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জীবন এখন অনেক জটিল, বিস্তৃত ও দুর্বোধ্য। ছোট ছোট সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনকে একেকটা মোড়ে বাঁক খাইয়ে কোথা থেকে কোথায় যে নিয়ে যেতে পারে !

সারাদিনে আমাদের যতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাঁর বেশির ভাগ শারীরিকভাবে রিফ্লেক্টিভ ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে থাকে, সেগুলো নিতে গভীর চিন্তার দরকার পড়ে না। বৈজ্ঞানিক সূত্রে আধুনিক মানুষ সারাদিনে নাকি কম বেশি ৩৫ হাজারের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে! এতো সিদ্ধান্তের মাঝে কিছুকিছু সিদ্ধান্ত আছে যেটা নিতে আমাদের সময় লাগে, চিন্তা করতে হয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি কাজ করে। আমার জীবনের আমি যখন দেখেছি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে, সেটা মাল্টিপল চয়েজ থেকে শুরু করে অনেক কিছুতে– যেখানে আমি তেমন কিছু বুঝতেই পারছি না, বা আমার কাছে যথেষ্ট ইনফরমেশন নাই। সে ক্ষেত্রে যে উত্তরটা ‘প্রথমবার’ মনে এসেছিল সেটাতে টিক দিয়ে চলে এসেছি। মনের গভীরে ঝাঁপ দেওয়ার যথেষ্ট সময় না থাকলে, এই পদ্ধতি কার্যকর। কারণ আপনার অর্জিত জ্ঞান আপনাকে প্রথমবারেই আপনার জন্যে সবচেয়ে অনুকূল সিদ্ধান্তটি আপনার মানস-পটে ভাসিয়ে তুলবে। এরপর যতো আপনি সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন, ততো বেশি অপশন আপনার সামনে আসবে , বিভ্রান্তি ও দ্বিধা বাড়বে বৈ কমবে না।

আরেক অগ্রজ আমাকে শিখিয়েছিল, ‘When you are deep doubt, follow your heart, listen to you heart , not your fear ! And if your heart isn’t responding, talk to your mother !’

নিজের হৃদয়ের কথা শোনা ভালো। ওই যে বলে না, নিজের বুদ্ধিতে মরাও ভালো। আরেকজনের বুদ্ধিতে মরলে আফসোস থাকবে, কেন যে ঐ কথা শুনতে গেলাম ! অনেকসময় হৃদয়ও দিশাহীন হয়ে পড়ে, কোন সাড়া পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপার আমি বহুবছর মেনে চলেছি, আম্মার সঙ্গে কথা বলতাম। পড়াশোনা, চাকরি, ক্যারিয়ার,বিয়ে , জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছে। হতে পারে, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় একমাত্র জন্মদাত্রী মা-ই সন্তানের নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্ক্ষী। সন্তানের সর্বোচ্চ শুভাকাঙ্ক্ষী জন্মদাত্রী ছাড়া অন্য কারো হতে পারাটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি।

এমন না যে, আমার মা উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি একেবারেই সাধারণ গৃহিণী ছিলেন। যতোবার আম্মার কাছে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে গেছি ; উনি অনেকক্ষণ মন দিয়ে শুনেছেন। তারপর আমার মতামতের ভিতর থেকেই উনি বুঝে ফেলতেন আসলে আমার জন্যে কোনটা ভালো হবে, সেটাই তিনি বেছে নিতে বলতেন। গভীর অন্ধকারেও আমার মায়ের মশালের আলোয় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আমার জন্যে দীর্ঘমেয়াদে ভালো হয়েছে।
যাঁদের মা বেঁচে আছে, তাঁরা সৌভাগ্যবান। আর যাঁদের জননী প্রয়াত হয়েছেন, তাঁরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের গাট ফিলিংসের উপরে ভরসা রাখুন।

উপলব্ধি: ২৯

আমি সেই অর্থে কর্মঠ বা পরিশ্রমী লোক নই। এবং সম্ভবত: আলস্য থেকেই আমার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অনুৎসাহ আছে। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছি, অফিসে ও পরিবারে নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে হস্তান্তর করেছি।
যে কাজ আমি অনেকদিন করার পরে একটা দক্ষতা অর্জন করেছি, খুব ভালোভাবে পারি, রোজ রোজ সেই একই কাজ কেন করব– সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। কর্মস্থলে আমার অনেক দায়িত্ব নির্দিষ্ট সময় পর আমার অনুজ কর্মকর্তাদের ডেলিগেট করেছি। আমি অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি।

যদিও আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে এই ডেলিগেশনের সুফল ও কুফল দুইই আছে।
আমার ভিতরে শিক্ষক-সুলভ কিছুটা ঔদার্য আছে বোধকরি। শিক্ষকরা যে তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পান। শিক্ষকরা জানেন একজন ছাত্রকে সমস্ত শিক্ষা বিলিয়ে দিলেও তাঁর কোন ক্ষতি নেই, কারণ ছাত্রটি কখনো তাঁর প্রতিযোগী হবে । আমিও তাই করেছি, কখনও ভাবিনি, আমার জুনিয়র কর্মকর্তাকে সবকিছু ডেলিগেট করলে, তাঁকে আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে কাজ করতে দিলে সে আমার প্রতিযোগী হবে। মুশকিল হচ্ছে, আমি এভাবে ভাবিনি , কিন্তু আমার মালিকপক্ষ ও কয়েকজন অনুজ আমার বদান্যতার সুযোগ নিয়েছেন। কিন্তু এতে করেও এতোগুলো বছর পরেও আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।