আমার কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতা নেই।
তবে, জীবিত একজন মানুষকে আমার ভূত বলে ভয় হতো। দাদাকে কবর দেয়া হয়েছিল মিরপুরের কালশী গোরস্থানে। আব্বা ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। ঈদ ও নানা পার্বণে দাদার গোরখোদক আমাদের বাড়িতে সাহায্যের জন্য আসত। আমি বলছি ৮০-৮১ সালের কথা। আব্বা সবসময় টুকটাক সামর্থ্য মতো সাহায্য করতেন।
গোরখোদক ছিল উর্দুভাষী। কেন জানিনা তাঁকে আমি কখনো দিনের আলোতে আসতে দেখিনি। হতে পারে, কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ সেরে ঠিক ভরা সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ির গেটে এসে টুকটুক করে ধাক্কা দিত। ঘর থেকে আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বোঝার চেষ্টা করতাম , কেউ দরজায় আছে নাকি নেই!
সবসময় একটা সাদা ময়লাটে লুঙ্গি আর সবুজ তেল চিটচিটে একটা ফতুয়া পড়তে দেখেছি তাকে। নতুন জামা দিলেও সে এটাই পড়ে আসত। আমার জন্য ভয়ের ব্যাপার ছিল তার খ্যাসখ্যাসে স্বর, দৈহিক গঠন আর চেহারা। চুলহীন, ভাঙ্গা গালের মিশমিশে কাল, কঙ্কালসার প্রায় ৬ ফুট লম্বা লোকটিকে দেখলেই আমার ভয় লাগত। মৃত্যুর মতো একটা দুর্বোধ্য ব্যাপারের সঙ্গে সে জড়িত। আমার মৃত্যু চেতনা তখনও কিছুই হয় নি। অসুস্থতা ও বয়স্কদের মৃত্যু যে ভাল কিছু না , সেটা বুঝতাম।
মিরপুর তখনো পাড়াগাঁয়ের মত। মেইন রোড থেকে শুরু ভাঙ্গাচোরা গলির রাস্তা, কিছু বাড়ির সামনে টিমটিমে গোল হলুদ বাতি ; সেটা এক ফুট দূরের অন্ধকারকেও আলোকিত করতে পারত না। সন্ধ্যার পরে মুরগীর খোঁয়াড়ে ঢোকার মতো করে বাচ্চারা টেবিলে টেবিলে হ্যারিকেন নিয়ে বসতাম। প্রতি সন্ধ্যায় আবশ্যিকভাবে লোডশেডিং। কখনো ৯টার নাটকের আগে আগে ফিরত; কখনো আরো দেরীতে।
সেই আবছায়া সময়ে দাদার গোরখোদককে দেখলেই আমি ভয় পেতাম। আচমকা যে কোন এক সন্ধ্যায় লোকটার সেই ফ্যাসফ্যাসে গলায়, মাথা নিচু করে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে ‘ বাবু ওয়াকিল সাহাব ঘরমে হ্যায় কেয়া ?’ অথবা আধভাঙ্গা বাংলায় ‘ওকিল সাহাব ঘোরে আছে বাবু ?’- শুনেই আমি ভয়ে কাবু হয়ে যেতাম।
এমনিতেই হয়তো জ্বর এসেছিল, আম্মা ধরে নিলেন ভয় পেয়ে হয়েছে। মনে আছে, পরের বার আম্মা তাকে ওইভাবে সন্ধ্যাবেলায় না আসতে আর আমার ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কটু কথা বলেছিল। দিনের আলোতে আসতে বলেছিল। কিন্তু , তার মতো নিরীহ একটা লোককে, ছোট্ট একটা বাচ্চা কেন ভয় পাচ্ছে, সেটা সেও নিশ্চয় মাথা নিচু করে ভাবত।
প্রথম প্রকাশ্ঃ ১২ই ডিসেম্বর,২০১৯
সাম্প্রতিক মন্তব্য