প্রিয় বই, নতুন করে পড়া।
সিদ্ধার্থ ।।মূলঃ হেরমান হেস( Hermann Hess) । অনুবাদ –জাফর আলম।
সিদ্ধার্থ উত্তর দিল , ‘ হ্যাঁ অনেক সময় নতুন ভাবনা এসেছে আমার মনে ; হয়তো উপলব্ধি করেছি নতুন কোন জ্ঞান ; কিন্তু আজ সব কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলা কঠিন হবে । গোবিন্দ, যে-কথাটি সবচেয়ে গভীর ছাপ দিয়েছে আমার মনে তা হল এইঃ জ্ঞান কাউকে শেখানো যায় না, দেওয়া যায় না । জ্ঞানী লোক যখন জ্ঞান বিতরণের চেষ্টা করেন তখন সে চেষ্টা আমার কাছে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হয় ।’
‘ তুমি কি উপহাস করছ ? ’ গোবিন্দ জিজ্ঞাসা করল।
‘ না পরিহাস নয়। সারাজীবন খুঁজে যা আবিষ্কার করেছি, তোমাকে তাই বলেছি। বিদ্যা অন্যকে দেওয়া যায় , জ্ঞান দেওয়া যায় না। জ্ঞান নিজের সাধনা দ্বারা লাভ করতে হয় ; যিনি জ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর জীবন পূর্ণ হলেও এবং জ্ঞানের সাহায্যে বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারলেও সে জ্ঞান কাউকে দান করতে পারবেন না । যোগ্যতম শিষ্যকেও শিখিয়ে দেওয়া যায় না জ্ঞানের রহস্য। যৌবনেই এ বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল , তাই গুরুর শিক্ষা ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম । গোবিন্দ, প্রত্যেক সত্যের বিপরীতটাও সমান সত্য – হয়তো এ-কথা তুমি পরিহাস বা আমার নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করবে । কিন্তু আমার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এ-কথা বলছি। একমাত্র আংশিক সত্যকেই কথায় প্রকাশ করা যায় । যা-কিছু আমরা চিন্তা করি বা কথায় প্রকাশ করি তা সত্যের একাংশ মাত্র ; সত্যকে প্রকাশ করলেই তার সমগ্রতা , পূর্ণতা এবং ঐক্য ক্ষুণ্ণ হয় । বুদ্ধ যখন উপদেশ দিয়েছেন শিষ্যদের, তখন তিনি জগৎ কে ভাগ করে নিয়েছেন সংসার ও নির্বান, মায়া ও সত্য এবং দুঃখ ও মুক্তির মধ্যে। এছাড়া উপায় নেই ; যাঁরা দিতে চান তাঁদের এ পথই গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু যে জগতে আমরা বাস করি , যে জগ ৎ আমদের চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছে তা তো খন্ডিত নয় । কোনো লোক বা কোনো কাজই সম্পূর্ণরূপে সংসার বা নির্বাণ নয় ; সম্পূর্ণরূপে সাধু বা পাপী কেউ নয় । অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সত্য— এই ভ্রান্ত ধারণার ফলেই আমরা ভুল করি । গোবিন্দ , সময়ের এই বিভাগ প্রকৃত নয় ; বারবার এ সত্য উপলব্ধি করেছি । সময় যদি সত্য না হয় , তাহলে বর্তমান জগত ও অনন্ত জগতের ব্যবধান , আনন্দ ও বেদনা , মঙ্গল ও অমঙ্গলের পার্থক্যও মিথ্যা ও মায়া ।’
‘………. গোবিন্দ , এই সৃষ্টি অসম্পূর্ণ নয়, ধীরে ধীরে পূর্ণতার পথে বিবর্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই এই সৃষ্টির। প্রতি মুহূর্তেই জগত পূর্ণ ; প্রত্যেক পাপের সাথে আছে ঈশ্বরের কৃপা ,প্রত্যকে বালকের মধ্যে আছে ভবিষ্যতের বৃদ্ধ ,প্রত্যেক দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে আছে মৃত্যুর বীজ ,প্রত্যেক মুমূর্ষের মধ্যে আছে অনন্ত জীবনের ইঙ্গিত ।বুদ্ধ আছেন দস্যুর মধ্যে, জুয়ারীর অন্তরে ; আবার দস্যুর খোঁজ পাওয়া যাবে ব্রাহ্মণের মধ্যে। গভীর ধ্যানের সময়কালের ব্যবধান দূর করা সম্ভব হয় , যুগপৎ দেখা যায় সমগ্র অতীত ,বর্তমান ও ভবিষ্যতের অখন্ড রূপ । আমার তাই মনে হয় জগতের সবকিছুই শুভ ; জীবন ও মৃত্যু , পাপ ও পুণ্য , জ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতা – সবই ভালো। এদের প্রত্যকেরই প্রয়োজন আছে আমাদের জীবনে; এদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে নিজেকে , স্বীকার করে নিতে হবে এদের , জগতের ভালো মন্দ সব কিছুই সহানুভূতির চোখে দেখতে হবে। ‘
সাম্প্রতিক মন্তব্য