ফেসবুককে আমার প্রথম থেকেই মনে হতো একটা ঘরোয়া আড্ডার মতো। একটা লিটল ম্যাগাজিন পড়ার অনুভূতি থাকত। লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে যেমন সারাক্ষণ তরতাজা মচমচে স্বাদু অনুভূতির ছাপানো হরফ থাকে , সেইরকম । এই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়েছে। অসাধারণ কিছু মেধাবী লেখকের দৈনন্দিন দিনলিপি পড়ার সুযোগ ঘটেছে। আমি আরো বেশি রাজনীতি ও সমাজ সচেতন হয়েছি। নবীন প্রজন্মের কিছু চিন্তক , দার্শনিক , কবি ও সাহিত্যিকদের লেখা প্রতিদিন পড়ার সৌভাগ্য হচ্ছে। এঁদের একজন সতীর্থ আহসান। গতকাল , কিছু কথোপকথনের পরে, তিনি আমার লেখালেখি সম্বন্ধে কিছু বললেন। আমার কাছে ,সেটা অসংখ্য লাইক , লাভ, ওয়াও ইমোজি চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অনুমতি নিয়েই নিজের ওয়ালে পোস্ট করলাম।

“ আপনার লেখাজোকা ফেসবুকে যা প্রকাশিত হতো, মাঝেমধ্যে পড়া হত। হয়তো রিএকশন দিতাম, কখনো কখনো দিতাম না। আপনি মূলত প্রবন্ধ ঘরানার লেখা লিখে থাকেন। মোটামুটি লম্বা লম্বা বাক্যে। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। যেন শ্বাসরুদ্ধকর কোনো ফিকশন পড়ছি, এমন একটা অনুভূতি জাগে। সেই টানা টানা শ্বাসরুদ্ধকর বাক্যগুলোর মাধ্যমে যে চিন্তার প্রকাশ ঘটান সেটা সব সময়ই কোনো না কোনো ভাবে চিন্তা উদ্রেককারী হয়ে থাকে।

পরিচ্ছন্ন ভাষা আর গোছানো চিন্তা আপনার লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বোঝা যায় আপনি দুনিয়াকে অবহেলিত শোষিত পীড়িত মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। গণমানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়– এমন কোনো আচরণ আপনাকে ক্রুদ্ধ আর ব্যথিত করে। সেই মনোভাবকেই আপনি শৈল্পিক ভাষায় উপমায় প্রকাশ করেন। আমি শুধু অনুরোধ করব, এই ক্রোধ/দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি আরেকটা স্টেপ যোগ করুন। যেটা হচ্ছে, সেই বিপর্যয়টা কীভাবে কাটিয়ে উঠা যায় সেটার পরামর্শ দিতে পারেন। দেশি বিদেশি নানা উদাহরণ সহযোগে। এতে আমার মনে হয়, আপনার লেখাটার গুরুত্ব আরো বাড়বে। আপনি নিজে কী, নিজে ঠিক বুঝতে পারছেন না, এর কারণ আত্মবিশ্বাসহীনতা। এইটা একটা মারাত্মক ব্যাধি জাহিদ ভাই। এই রোগে যারে ধরে সে সাধারণত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।

এবার আরেকটা কথা শুনেন। আপনি থাকেন ২ নাম্বার রোডে। আর আমি থাকতাম ৩ নাম্বার রোডে। আপনার ঠিক বিপরীত রোডেই। আপনি বেশ কয়েকবার আড্ডার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি প্রায়ই আপনার বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে আসতাম। কিন্তু আপনাকে জানিয়ে যাওয়া হতো না। কারণ, সেই তীব্র হীনমন্যতা। আমি ওখানে থাকতাম, একাই লাগত। আপনার সাথে প্রায়ই আড্ডা দিতে ইচ্ছা হতো। সাহিত্য আড্ডা আর কি। কিন্তু তখনই আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যেত। এই জন্য দুঃখিত। সামনে কখনো গেলে, এই নেকাব আর রাখব না। এই যে আমার আত্মবিশ্বাসহীনতা, এইটা অনেকগুলো সম্ভাবনাকে খুন করে থাকবে। হয়ত মনের সব বাঁধা পেরিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে পারলে আমাদের চমৎকার সব সাহিত্য-আড্ডার অভিজ্ঞতা ঘটতে পারত। আপনার পরামর্শ বা কথাবার্তা আমার লেখাকে সমৃদ্ধ করতে পারত। আমার কোনো পরামর্শ হয়ত আপনারও কাজে লাগত। কিন্তু আমার এই আত্মবিশ্বাসহীনতা সে সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিলো।
আপনার লেখার হাত যথেষ্ট ভাল। চিন্তা পরিষ্কার। বইয়ে স্থান দেবার মত লেখা। শুধু একটু মনোযোগ আর আত্মবিশ্বাস বিনিয়োগের অভাব। মনে যা আসে, লিখতে থাকুন, তা যতই খারাপই হোক, এতে লেখার ফ্লো টা ঠিক থাকে। এই ফ্লো খুব ইম্পরট্যান্ট জিনিস। আর সময় পেলেই নানা বই পড়বেন। লেখার ফ্লো তৈরিতে বই পাঠের ভূমিকা অনেক। চিন্তাও সমৃদ্ধ হয়।

লেখা থেকে ধর্ম আর রাজনৈতিক বিষয়টা যেন সরাসরি না আসে তা খেয়াল রাখবেন। জানেনই তো এইদেশে মুক্তভাবে কথা বলার পরিবেশ নাই। একটা পদ্ধতি আছে, সেটার মাধ্যমে আপনি ধর্ম ও রাজনীতিকেও সমালোচনা করতে পারবেন। সেটা আপোষ পদ্ধতি বা ছলনা পদ্ধতি। এমনভাবে লিখতে হবে যাতে মনে হয় আপনি তাদের বিপক্ষের কেউ না। তাদেরই একজন। বন্ধ বান্ধব যেমন নিজেদের বন্ধু বান্ধবদের সমালোচনা করে। এই রকম আর কি। তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে এই দুইটা বিষয় এড়িয়ে চলাই অধিকতর ভালো। লেখার মত দুনিয়ায় কত বিষয় আছে ভাই। তবুও এই দুইটাই যদি আপনাকে বেশি পীড়িত করে, তাহলে অবশ্যই ডিরেক্ট ম্যাথডে লিখবেন না। নানা ছলনার আশ্রয় নিবেন। এতে মূল কাজটাও হয়ে গেল, আপনিও টার্গেট হলেন না।

যা করুন, আর নিজেকে অবহেলা করবেন না। আপনাকে ক্লাসিক লেখক হতে হবে এই দিব্বি কে দিছে। আপনি একজন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিশেবে আপনার মতামত প্রকাশ করবেন দুই মলাটের মধ্যে। এবং, সেটা খুব ভাল ভাবে সম্পন্ন করার যথেষ্ট যোগ্যতা আপনার রয়েছে। জাস্ট শুরু করে দিন।”

প্রথম প্রকাশঃ ১৮ই জানুয়ারি, ২০২০