বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী , অপু, দুর্গা, নিশ্চিন্দিপুর, হরিহর, সর্বজয়া, ইন্দির ঠাক্রুন , আম আঁটির ভেঁপু – আমার মনে হয়, আমরাই শেষ আলোড়িত প্রজন্ম । ১৯২৯ সালে লেখা এই উপন্যাস গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির সারাজীবনের অংশ হয়ে গেছে । কৈশোরে আমরা প্রত্যেকেই অপু বা দুর্গা। আমাদের বাবাদের কেউ কেউ হরিহর , মায়েদের কেউ সর্বজয়া !
পথের পাঁচালীর শেষের কয়েক লাইন আমাদের বার বার পড়তে হয়।
“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন – মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নিতোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতেরখেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সুর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গন্ডি এড়িয়ে অপরিচয়েরউদ্দেশ্যে…
দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মনন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-সপ্ন শেওলা-ছাতারদলে ভরে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না… চলে… চলে… চলে… এগিয়েই চলে…
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ…
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!…
চল এগিয়ে যাই”
কয়েকটাদিন কবিতা নিয়ে মেতে ছিলাম। ‘দেশ ’ পত্রিকার কবিতা সংকলনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তারাপদ রায়ের কবিতাটা ভালো লেগে গেলো।
শতবার্ষিকীর ছায়াপদ্য
তারাপদ রায়
‘Ah , did you once see Shelley , plain….?’
সত্যি, আপনি বিভূতিভূষণকে মুখোমুখি দেখেছিলেন?
সাদামাটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়?
বনগ্রাম স্টেশনে একদিন দুপুর পার হয়ে প্রায় বিকেলে ,
প্রায় ফাঁকা যশোহর লোকালে উঠে আপনি দেখলেন
ওদিকের সীটে জানালার ধারে তিনি বসে আছেন ?
অল্পদিন আগে কোথায় এক সাহিত্যসভায় দেখেছিলেন,
তাই তাঁকে চিনতে আপনার অসুবিধা হল না।
সেই হালকা-নীল কলারফাটা হাফশার্ট ,
আধময়লা মিলের ধুতি ,তাপ্পি মারা ক্যাম্বিসের জুতো ।
অনেকদিন আগের কথা
তবু মনে আছে আপনার ?
যশোহর রোড কোনাকুনি ভাবে কাটিয়ে
শিয়ালদহ চলেছে দুপুরের নিঝুম রেলগাড়ি ।
জানালার পাশে বিভূতিভূষণ, আপনার মুখোমুখি ।
রেলগাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে ধলচিতের খেয়াঘাট ,
সোনাডাঙ্গার মাঠ, পদ্মফুলে ভঁরা মধুখালির বিল,
নীলকুঠির সাহেবের আমলের তুঁতগাছ পড়ে থাকছে পিছনে ।
বিভূতিভূষণের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন ?
আশ্চর্য ! কী বলেছিলেন আপনি , সেটা মনে নেই?
বিভূতিভূষণ আপনার কথার উত্তর দিয়েছিলেন ,
কী বলেছিলেন বিভূতিভূষণ – তাও আপনি ভুলে গেছেন ?
তা হলে আপনার শুধুই মনে আছে,
চলন্ত রেলগাড়ির কামরায় জানালার পাশে,
পুরনো নীল জামা গায়ে বসে আছেন বিভূতিভূষণ ।
বিকেল গড়িয়ে পড়ছে রেলপথের পাশে
বন অপরাজিতার নীলফুলে ছাওয়া বনের মাথায় ,
পাখি ডাকছে শিরীষ-সোঁদালি বনে,
রেলগাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে সোনাডাঙ্গার মাঠ,
মধুখালির বিল, ধলচিতের খেয়াঘাট ।
অপরাহ্ণের রাঙা রোদ জানালা দিয়ে ঢুকেছে কামরায়
নীল নির্জন আকাশ পথে গাঙচিলের ডাক
বাঁশঝাড়ের মাথায় দিনের শেষ আলো
দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মৃত্যু পার হয়ে
মাস, বার, মন্বন্তর , মহাযুগ পার হয়ে,
ঝোঁপে ঝোঁপে নাটা-কাঁটা বনকলমির ফুল
যশোহর লোকালের ফাঁকা কামরায় কাঠের বেঞ্চিতে
বসে আছেন নিঃসঙ্গ ; নির্লিপ্ত বিভূতিভূষণ ।
সত্যি, আপনার মনে আছে ?
সত্যি, আপনি দেখেছিলেন বিভূতিভূষণকে ?
সাম্প্রতিক মন্তব্য