আমাদের আশির দশকের শৈশবে কতো রকমের ফ্যান্টাসি ছিল !
এই প্রজন্মেও আছে নিশ্চয়, কিন্তু সেটা কখনো জানার চেষ্টা করা হয়নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপড়েনে মাসের ২০ তারিখ গেলেই পাশের বাসার খালাম্মাদের কাছে ধারদেনা চাইতে হতো। আমরা একটা কিছু শখ করলাম, আর সেটা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবো, সেটা এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতাম না।
সচ্ছল বন্ধুরা যারা ছিল, দেখতাম অমুকের চাচা আমেরিকা থেকে নতুন গান শোনার ওয়াকম্যান পাঠিয়েছে। অথবা কোন পিকনিকে দেখলাম, তার হাতে নতুন ইয়াশিকা ক্যামেরা। তার মামা পাঠিয়েছে। আমরা শাব্দিক অর্থেই জুলজুল করে সেটা চেয়ে দেখতাম।
চাওয়া আর পাওয়ার এই বিস্তর ফারাক আমাকে মাঝে মাঝে ফ্যান্টাসিতে ভোগাতো। কেন সামান্য একটা বাইসাইকেল কিনে দেওয়া যায় না? অথবা কেন একটা ক্যামেরা আমাদের কেনা হয় না? এসব অপ্রাপ্তি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বেদনা কাজ করত। আর আমাদের বিনোদন যেহেতু ছিল সিনেমা অথবা বিটিভির নাটক, সেগুলো দেখে দেখে কোন কাহিনীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতাম।
আম্মার কাছে কিছু চেয়ে না পেলে মনে হতো , ধ্যাত্ ! কী একটা গরিবগুরবোর ঘরে এসে পড়েছি রে বাবা ! সিনেমার কাহিনীর বিশাল ধনী কেউ একদিন এসে নিশ্চয়ই বলবে, ‘আরে এই ছেলে তো আমাদের! ভুল করে এই পরিবারে চলে এসেছে ! যাই হোক একে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।’ তারপরে সেই সাম্রাজ্যের একক অধিপতি আমি! যা চাই, তাই পাই। চেয়ে না পাওয়ার ফালতু জীবন একদিনে বদলে যাবে।
আবার ভাবতাম, এই যে আমি মহল্লার ভালো ছাত্রদের একজন; অথচ কেউ আমাকে একটু প্রশংসাও করে না ! সিনেমায় দেখায় না, পরিচয় লুকিয়ে মানুষের বাড়ি গৃহপরিচারকের কাজ করছে নায়ক। সে রকমটি করে যদি পরিচয় লুকিয়ে কোন বিশাল বড়লোকের বাড়ির কাজের ছেলে হই ; তাহলে আমার এইযে পাটিগণিত, বীজগণিতের দক্ষতা সেই বাড়ির সুন্দরী কন্যাকে হুট করে একদিন দেখিয়ে দিতে পারতাম। তারপর ধন্য ধন্য পড়ে যেতো। সবাই টের পেত, আহা , ছেলেটি তো হীরের টুকরো ! তারপর আর কী ! সেই ফ্যান্টাসি বড়লোকের একমাত্র উর্বশী কন্যার সঙ্গে প্রেম পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতাম।
কর্পোরেট চাকরির প্রথমদিকে একটা ফ্যান্টাসি ছিল কিছুদিন। এই যে, আমরা সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টের একধাপ উপরে আছি বলে কারখানার ছোটখাটো খুঁত ভুলত্রুটি বের করে খুব বাহাদুরি দেখাই। ভাবখানা, আমাদের না জানি কতো জ্ঞান গম্মি ! পরিচয় লুকিয়ে কোন ছোট্ট প্রতিষ্ঠানে, খুব ছোট একটা পদে যোগদান করতে পারি, তাহলে কী হতে পারে ! তাহলে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে কার্যকরী জ্ঞান প্রয়োগ করে, ঠিক ঠিক উল্টোভাবে কর্পোরেট অফিসের নাদানদের নাকি দড়ি দিয়ে ঘোরাতাম !
অথবা এই যে ,সেলস আর মার্কেটিং এর জন্য বিদেশে বিদেশে ঘুরি। এমন কী হতে পারে, পরিচয় লুকিয়ে কোন ছোট্ট শাড়ির দোকান অথবা মনোহারী দোকানে সেলসম্যান হলাম। বা কোন একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ বা ছোট্ট হোটেলে বেয়ারার চাকরি করা শুরু করলাম। এটাতো সম্ভব, কে আর মানা করবে ! আমি যদি ঢাকার দূরপ্রান্তে অথবা ঢাকার বাইরের গিয়ে করি, কেউ তো আর চিনবে না যে, আমি টেক্স-ইবোর জাহিদ ! আর যদি পরিচিত কেউ যদি চিনেও ফেলে, এমনও তো হতে পারে সে আমাকে না চেনার ভাণ করে একটু বেশি বখশিশ দিয়ে চলে গেল। সেই লোক বাসায় ফিরে নিজের স্ত্রীকে আর ফোন করে বন্ধুদের বলল, ‘জানিস, জাহিদ সাহেব ছিল না, সেতো এখন এই করে চলছে, আহা !’
পশ্চিমের দেশে এটা সম্ভব।পৃথিবীর সবদেশ থেকে কতো তাবৎ বড়ো মাপের লোকেরা নিউইয়র্কে, প্যারিসে গিয়ে ট্যাক্সি চালায়, ওয়ালমার্টে বাচ্চাদের ন্যাপি বিক্রি করে।যদিও সেটা আরেক জীবনসংগ্রামের কাহিনী। ওখানে তো আর পেশার জাত্যভিমান নেই। একজন ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের জন্যও পার্টটাইম অড জব খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
আমাদের দেশে পরিচয় লুকিয়ে কাজ করার সুবিধা একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থার আছে। এরশাদশাহীর আমলে তার স্বৈরাচার সামলানোর জন্য চারিদিকে ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা ঘুরতো। হ্যাঁ ,পরিচয় লুকিয়ে কাজ করার সুবিধা আছে আমাদের সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রী আমলাদেরও। কেমন করে যেন, তারা যে আসলে ‘জনগণের সেবক’ ; সেই পরিচয় দিব্যি লুকিয়ে ফেলেছে আর সামন্ত-প্রভুদের মতো কুৎসিত থেকে কুৎসিততম আচরণ করছে আমাদের আমজনতার সাথে !
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ!’
শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে আর যৌবনে আমাদের প্রজন্ম কী কী ধরণের ফ্যান্টাসিতে ভুগেছে, সেটা বোধকরি কখনই বলা ঠিক হবে না। বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট!
প্রকাশকালঃ ৮ই অক্টোবর,২০২০
সাম্প্রতিক মন্তব্য