নারীপুরুষ নির্বিশেষে একজীবনে বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়ে। কেউ সেটা প্রকাশ করে , কেউ করে না ; কেউ করতে পারে না। যতো বড় ভালোবাসার বিয়েই হোক না কেন ; একযুগ পরে সেই ভালোবাসার তীব্রতা ফিকে হয়ে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা মাস ছয়েকেই হয়ে যায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিবাহবিচ্ছেদের দামামা বাজে। সন্তানাদিসহ অথবা ব্যতীত সব ডিভোর্সের নানাবিধ সামাজিক, পারিবারিক , আর্থিক কারণগুলো সবাই খালি চোখে দেখেন , আলোচনা করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা আলোচনার বাইরে, অবহেলিত থেকে যায় , সেটা হচ্ছে দম্পতির যৌনজীবন। বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ শারীরিক সমঝোতা না হওয়া। শারীরিক দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। দাম্পত্যের শুরুতে বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের সেই উত্তুঙ্গ, শীর্ষানুভূতি থাকে তা একসময় থিতু হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন:

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বাঁধে।।

যুগ পেরিয়ে দাম্পত্যে তখন একজনের অঙ্গ কাঁদলেও আরেকজনের আর কাঁদে না।

যাই হোক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের হিসাবে, চল্লিশের পরপর অনেক পুরুষের টেস্টাস্টেরন হরমোন কমে না গিয়ে বরং বেড়ে যায় আর নারীর এস্ট্রোজেন হরমোন কমে গিয়ে ঋতুবিরতি বা মেনোপজ হয় ! এই প্রাকৃতিক অবিচার কীভাবে হয়েছে , কেন হয়েছে , কে জানে ! তাই, মাঝবয়সে সংসারের অনেক পুরুষ ঠিকই ‘ছোঁকছোঁক করে সম্ভোগের জন্য এবং চিহ্নিত হয় তথাকথিত যৌনকাতর হিসাবে। পুরুষ পরিতৃপ্তি খুঁজে ফেরে যেনতেন করে হলেও স্খলনের মাঝে। পুরুষ পৃথিবীর সকল সব চাপ ঝেড়ে ফেলতে চায় রাতের শয্যায়।

ওদিকে বিবাহিতা নারীটির শরীরে ভাটা এসেছে, মোটেও তা নয়। মেনোপজ বা প্রি-মেনোপজের মুখোমুখি হলে, শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েও যৌনজীবন ধরে রাখা যায় ; সেটা না ভেবে , যৌনজীবন শেষ হয়ে গেছে বলে ভুল ধারণা করে বসে থাকে নারী। দৈহিকতা তখন আর নারীটির প্রায়োরিটি থাকে না। এটাও সত্য , বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারী শুধুমাত্র স্ত্রী ও শয্যাসঙ্গিনী থেকে পরিবর্তিত হয়ে সার্বক্ষণিক ‘মা’ -এর দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই আমার মনে হয় দৈহিকতা নিয়ে একটা বোঝাপড়া মধ্যবয়সী দম্পতিদের থাকা উচিৎ। বোঝাপড়া স্বচ্ছ হলে, চাহিদা ও যোগানের ; আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির একটা ভারসাম্য থাকে। চাহিদার তুলনায় জোগানের পার্থক্যের কারণে দৈহিকতা বরং আরো বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

সকল বিবাহিত পুরুষের সমস্যা বোধকরি এরকম: গতরাতে দৈহিকতা হয়েছে, আজ রাতেও হতে পারে। হলে ভালো হয়। অথবা গতকাল বা গত পরশু হয়নি , আজ হতে পারে, হওয়া উচিৎ। সে প্রায় প্রতি রাতেই একটা সুপ্ত কিন্তু উদগ্র যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। হতেও পারে, নাও হতে পারে ; হতেও পারে, নাও হতে পারে।

মাঝবয়সে এসে , সংসারে বিবাহিতা নারীর উপর সারাদিনে শারীরিক-মানসিক ধকল তো আর কম যায় না। তাদের সারাদিনের চিন্তা তো শুধু পুরুষের মতো রাতের শয্যার দৈহিকতা নিয়ে না। যুক্তিসঙ্গত কারণে হয়তো সেই রাতে যৌনতা হয় না। পরের রাতেও অনেক দেরি করে বিছানায় আসে নারী ; শ্বশুরের সেবা, সন্তানদের কোচিং , পরীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত পুরুষকুলের অফিস আর রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যামের কিছু হ্যাপা ছাড়া তেমন কোন শারীরিক কসরত থাকে না। তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গম। তাই একটা অনিশ্চিত বিরতির চক্রে পড়ে যায় তার তীব্র শারীরিক কামনা। এই যে, আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির একটা ফারাক তৈরি হয় ; সেখান থেকেই শুরু হয়, বিবাহিত পুরুষ ও নারীর দূরে সরে যাওয়ার চিরন্তন সমস্যা। খুব ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছ থেকে শারীরিকভাবে তারা দূরে সরে যেতে থাকে। একজন আরেকজনের কাছে আরাধ্য না হয়ে অভ্যস্ত কিন্তু অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েন এবং এটাকেই স্বাভাবিক ভাবা শুরু করেন। তৈরি হয় অনতিক্রম্য মানসিক দূরত্ব। নানা সুতোয় বাঁধা পড়ে সংসার চলে সংসারের নিয়মে, টুকটুক করে। কিন্তু সুর কেটে যায়। কারো কারো এভাবেই আরো কয়েকবছর কেটে গেলে যৌনতাহীন জীবনকেই স্বাভাবিক মনে হয়। সামাজিকভাবেও সেটা ভালো চোখে দেখা হয়, তাদেরকে বলা হয়, আর কত ! হয়েছে তো অনেকদিন।

ফিরে আসি আগের আলোচনায়। মূলতঃ ঋতুচক্র শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরপর কয়েকদিন নারী তার যৌন স্পর্শকাতরতার চূড়ায় থাকে। এ সময়ে নারী যৌনতা তো উপভোগ করেই ; পুরুষের জন্যও সেটা উপভোগ্য হয়। ঋতুচক্র শুরু আর শেষ এবং অব্যবহিত পরে মোট ১০ দিন নিরাপদ সময়ে ন্যূনতম ২ বা ততোধিক দিন যৌনতা থাকলে ভাল। এরপরের বাকী থাকে অনিরাপদ ১৭/১৮ দিন । এই দিনগুলোতে সর্বোচ্চ কতোদিন দিন আকাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিৎ ? প্রতি তিনদিনে একদিন হলে ছয় বার । সেটা পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষিত হলে তো কোন সমস্যা না। কিন্তু আমাদের সংসারের নারীরা হয়তো এই বয়েসে এসে এই ফ্রিকোয়েন্সির জন্য সামাজিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। অথচ বেশিরভাগ পুরুষ ভেবে থাকে, একদিন পরপর তিন সপ্তাহে ন্যূনতম ৮ বা ১০ বার যৌনতা তো হওয়া উচিৎ। যৌনতার এই ফ্রিকোয়েন্সি, বিবাহিত জীবনের শুরুতে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু মাঝবয়সে এসে প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি বলে নারী ধরে নেয়।

পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, হোমোস্যাপিয়েন্স পুরুষ জেগে থাকার সারাক্ষণ তো যৌনকাতর হয়ে থাকেই ; ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে যৌনতার স্বপ্নই দ্যাখে। অথচ অন্য সকল প্রাণী বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে যৌনকাতর হয়। তাদের যৌনতা বিবর্তনের ধারায় বংশবৈচিত্রের ও বংশরক্ষার। গরু, ছাগল, হাতি ঘোড়া, বাঘ, সিংহ থেকে থেকে শুরু করে সকল পশুপাখি ঘরের কুকুর বিড়ালও শুধুমাত্র নির্দিষ্ট মাসে কামার্ত হয়। বছরের বাকী মাসে এদের খাদ্য-সংগ্রহ, সন্তানের লালনপালন ছাড়া অন্য কোন কর্মবৈচিত্র থাকে না। নারী প্রাণীদেরও ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এই হোমোস্যাপিয়েন্সদের যৌনতা শুধু বছরের নির্দিষ্ট সময়ের বংশ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য না। যৌনতার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপট, সবল-দুর্বলের হিসাব, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা বা পরিশেষে নিখাদ আনন্দ লাভই মুখ্য হয়ে থাকে। আমরা যৌনতার ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় বেশ একটা ব্যতিক্রমী আচরণ করে থাকি। সে আরেক আলোচনা।

হোমোস্যপিয়েন্স নারীর যৌনতার জাদুর কাঠি বিবর্তনের ধাক্কায় আরো গভীরে চলে গেছে। ভেবে দেখেন যে, পুরুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্নায়ুগুলো দেহের বাইরে যৌনাঙ্গের মাথায় পাতলা একটা চামড়ার নীচে প্রায় উন্মুক্ত হয়ে আছে । আর অন্যদিকে নারীর স্পর্শকাতর জি-স্পট , অর্গাজম অথবা চরম-পুলক নিয়ে চলছে যুগের পর যুগ তর্কবিতর্ক। যেটা সচরাচর দেখা যায়, নারীদের জি-স্পট চামড়ার প্রায় দুই-তিন ইঞ্চি গভীরে। সেটিও অনেক নারী চিহ্নিত করতে পারে ; বেশিরভাগই পারে না। পুরুষের চরম-পুলক স্খলনের মাধ্যমে জাজ্বল্যমান। নারীর ক্ষেত্রে সেটা চিররহস্যময়। সুতরাং স্পর্শকাতরতায় হোমোস্যাপিয়েন্স পুরুষ প্রজাতি খামোখাই এগিয়ে আছে। পোশাক থেকে শুরু করে কোন কিছুর হালকা ঘর্ষণেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর নারীর যৌনতাকে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়; তাকে সিক্ত করতে হয় তারপরে না সেই আরাধ্য যৌনমিলনের প্রশ্ন আসে।

পুরুষদের যৌনকাতরতার কথা বলে শেষ করলে আলোচনা বড্ডো একপেশে হয়ে যায়। দিনশেষে আমি লেখক, নিজেও একজন পুরুষ। নিরপেক্ষতার জায়গাটা থাকছে না। যৌনতায় অনুৎসাহী নির্জীব পুরুষও নারীদের কাছে একইরকম যন্ত্রণার। উপমহাদেশের নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মাসের পর মাস, পুরুষের নির্জীবতার কথা কাউকে বললে ছিনাল বা খাইখাই নারী হিসাবে কুখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পুরুষকে যৌনতায় আগ্রহী করে তোলা ও যৌনজীবনে বৈচিত্র্য আনার কথা নারী কখনই বলে উঠতে পারে না। অথচ পাঠক, ‘কামসূত্র’ আমাদের এই উপমহাদেশেরই আর তা নিয়ে পশ্চিমের গবেষণা অদ্যাবধি চলমান। পুরুষ সামাজিকতা থেকে জেনে বসে আছে যে, যৌনতার পরিমিতিবোধ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক। আর নারী সেই বাল্যকাল থেকে মা-খালাদের কাছে শিখে এসেছে যৌনস্পৃহাকে অবদমিত করে রাখতে হয়। এ রকম একটা প্রাগৈতিহাসিক মনোভাব , যৌনতাকে অস্পৃশ্য ভাবা যে অসুস্থতা, সেটা নারীকে কে বোঝাবে !

দাম্পত্যের বাইরে যৌন স্বাধীনতা পুরুষের যৎসামান্য থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে তা শূন্যের কাছাকাছি। পুরুষ হিসাবে আপনি মিক্সড ফ্রুট সালাদ বা রুচির পরিবর্তনের কথা ঠাট্টা করে হলেও বলতে পারেন, বড়ো কোন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে না তা। কিন্তু নারী রুচির পরিবর্তনের কথা বললেই, সারা সমাজ তাকে বেশ্যামাগী থেকে শুরু করে যতোরকম পুরুষতান্ত্রিক অশ্লীল গালিতে জর্জরিত করে ফেলবে।

সারাদিন পরে ঘরে ফিরে পুরুষ স্নানাহার সেরে পত্রিকা হাতে টিভির সামনে বসে পড়ে। আর ভাবে, সে সারা দুনিয়া উদ্ধার করে এসেছে। অন্যদিকে, নারী সারাদিনের কাজের চাপে নিজেকে সিনিয়র গৃহপরিচারিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে পরস্পরের কাছে উপস্থাপনের তাগিদ বিয়ের প্রথম কয়েকবছর থাকে। তারপরে পুরুষ তার নোয়াপাতি ভুঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে, গোঁফের কোনে ডালের দাগ মেখেই টিভি দেখতে বসেন। আর নারী সেই সকালের পরিহিত সালোয়ার বা শাড়ী যেটা ঘামে ভিজে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে সেটা নিয়েই আশেপাশে গৃহকর্ম করে যেতে থাকেন। গুটি কয়েক সচেতন নারী ও পুরুষ হয়তো শয্যায় আসার আগে স্নান সেরে সুগন্ধি মাখেন। নিজেকে একটু হলেও ছিমছাম ও আকর্ষণীয় করে তোলেন, সে যৌনতার কারণেই হোক বা এমনিতেই।

উল্টোদিকে কর্মজীবী নারীরা নিজেকে তার অফিসের জন্য যেভাবে প্রতিদিন প্রস্তুত করে, তার ছিটেফোঁটাও কি গৃহের পুরুষটির জন্য করে ? ‘ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর’ তাই বলে সবকিছুকেই সহজলভ্য ও চিরস্থায়ী ভাবার বোকামি করা কি ঠিক ? অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আর যৌন স্বাধীনতাকে এক করে ফেলেন তারা। দিনশেষে তাদের আচরণও একজন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের মতো হয়ে যায়, সেটা তারা টেরও পান না। যখন টের পান ; তখন সম্পর্কের তারে মরিচা ধরে যায়।

ঘরের নারীকে শরীর সচেতন হতে বললেই সেটা পুরুষতান্ত্রিক চাহিদা হয়ে যায় না। নারীকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে থাকতে বললেই সেটা বাজারের বা মিডিয়ার নারীর ছলাকলায় অভ্যস্ত নারীদের সমতুল্য করা হয় না। একটা স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন প্রবৃত্তিকে অবহেলা করে আমাদের দাম্পত্য ও সংসারে আমরা কোন স্থায়ী সম্পর্কের প্রমাণ দিয়ে চলি , সেটা কে জানে !

তাই, হে পুরুষেরা ! নারীকে বুঝুন, নারীর যৌনতাকে বুঝুন।
আর হে নারীকুল ! পুরুষদের শারীরিক দুর্বলতাকে বুঝুন । পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার এই সম্পর্ককে একটা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু আনন্দময় অবস্থানে নিয়ে আসুন। মধ্যবয়সে পুরুষ যেন নিজেকে রিক্ত বা যৌনবঞ্চিত না ভাবে।
আবারো মনে করিয়ে দিই, জীবন সংক্ষিপ্ত, যৌনজীবন তারচেয়েও সংক্ষিপ্ত ! তাই সেটা উপভোগ্য করে তুলুন।

পাঠ করার জন্য ধন্যবাদ।।

প্রকাশকালঃ ১২ই অক্টোবর,২০২০