বড়কন্যার ছোটবেলা থেকেই মাছমাংসে অনীহা। সদ্য কৈশোরে পড়েছে। নিজের মতামত আছে । আবার, আমাকেও ওর মত মন দিয়ে শুনতে হয়। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয়। এই প্রজন্মের নতুন ট্রেন্ড প্রাণীজ আমিষ বর্জন করে নিরামিষাশী হওয়া। কেউ ভেজিটেরিয়ান কেউ কট্টর ভেগান। এরা প্রাণীহত্যাকে নিরুৎসাহিত করে। প্রাণীজ আমিষ না খাওয়ার পিছনে হাজারটি কারণ দেখায়। স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং পর্যন্ত এর প্রভাব। বড়টির দেখাদেখি ছোটকন্যাও একই পথের। সেও দুপুর ও রাতের দৈনিক খাবারে মাছমাংস খেতে চায় না। তবে, ফাস্টফুডের দোকানে ফ্রাইড চিকেনে এদের আপত্তি নেই ! চিকেন বারবিকিউ পিজা, বিফ পিজায়ও নেই কোন আপত্তি।
গত দুই দশকে বেশিরভাগ শিশুকিশোরদের মাছ মাংসের ব্যাপারে অনীহা দেখছি। তবে একটু বয়স হলে বন্ধুদের সঙ্গে চলে চলে অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। কেন এদের এই অনীহা ? আমার ধারণা এই অনীহা এসেছে সহজলভ্যতা ও প্রাচুর্য থেকে। আশির দশকে , আমাদের ছোট্ট সংসারে অন্যতম বিনোদন ছিল ছুটির দিনে একটু ভালমন্দ খাবার। গরুর মাংস, সঙ্গে সিজনাল মাছ। আর শাকসবজি তো প্রাত্যহিক ছিল। সকালের নাস্তায় হঠাৎ দুয়েকদিন পর সবজি ভাজির সঙ্গে ডিম। আস্ত ডিমের চেয়ে ভাগাভাগিটা ছিল স্বাভাবিক। কারো বাড়ি বেড়াতে গেলে অথবা বাসায় দাওয়াত থাকলে , তবেই ছোটবড় সবার পাতে আস্ত ডিম পাতে পড়ত।
কবে থেকে শুরু হয়েছিল মনে নেই, তবে সপ্তাহের একদিন ছিল মিটলেস ডে। ঐদিন কসাইখানায় গরুছাগল কাটা হোতো না। নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য তরকারি বাড়ন্ত থাকত। সবকিছুই মেপে রান্না করা হতো। মায়েরা ভাত বেড়ে বাতাস করতে করতে তরকারি বেড়ে দিত। খাবার সময়ে কেউ না কেউ পাশে বসে থাকত। আবার কৈশোরে কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আলাদা বাটিতে তরকারি বেড়ে রাখা হোতো।রঙ্গিন টিভি আর ফ্রিজ মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ঢুকেছে ৯০ এর দশকে। আর ফ্রিজ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাজা সবজি আর তরতাজা মাছমাংসের স্বাদ ভুলতে বসেছি আমরা।
আমার এক স্কুলবন্ধু ফ্রিজের খাবারের ব্যাপারে ভীষণ বিরক্ত ছিল। বাঘ সিংহ যেমন শিকার করে একটু খেয়ে ফেলে রাখে দেয় , মড়ি বানায় ; তারপরে দুইদিন পরে এসে আবার খায়। ফ্রিজ আসার পরে আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। তাজা খাওয়া বাদ। বাজার থেকে যা আসে, সব ঢুকে পড়ে ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজের গভীর পাকস্থলীতে। দিনের পর দিন , মাসের পর মাস অথবা বছর জুড়ে ঠাণ্ডায় জমে জমে প্রতিটা কোষের সাইটোপ্লাজম আর মাইটোকন্ড্রিয়ার রস বের হয়ে শুকনো ছিবড়ে হওয়ার পরে রান্নার চুলায় পৌঁছায় তা। সেই ছিবড়ে হওয়া মাছমাংসে কতোখানি পুষ্টিগুণ থাকে জানিনা ; তবে ন্যাচারাল স্বাদ যে পুরোটাই চলে যায়, সে দিব্যি করে বলা যায়।
আর কী নেই সেই ফ্রিজে ! এই বছরের কোরবানির মাংস, পরের বছরের শবে বরাতে খাওয়া। এপ্রিল-মে মাসের তাজা ইলিশ মড়ি হয়ে পড়ে থাকে ফ্রিজের এক কোনায়। পহেলা বৈশাখে সেই বিস্বাদ ইলিশ পাতে ওঠে। কিছুদিন আগে বাসার ডিপ ফ্রিজ গেল বিগড়ে । আমার গিন্নী ধীরে ধীরে সবকিছু বের করা শুরু করলেন। করোনাকালীন বাসায় থাকি বলেই, সেই দুর্লভ দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হল । একেকটা আইটেম বের করেন আমি বিস্মিত হই। অপেক্ষা করি আর কী বের হয় দেখার জন্য ! কবে কোন প্রস্তর যুগে কক্সবাজারের কেনা শুটকি মাছ থেকে শুরু করে গাজর, ছোলা, মটরশুঁটি কী নেই ! মাছ মাংসের পোঁটলাগুলোর এমনতর অবস্থা যে, গিন্নী নিজেই ভুলে গেছেন ভিতরে কোন পদের মাছ ! পুরো ফ্রিজের মালপত্র বের করা দেখে বিস্মিত হচ্ছি দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন , আমি কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি কীনা । আমি বললাম, যেভাবে অতিপুরাতন জিনিসপত্র বের হচ্ছে, এক পোঁটলা ডাইনোসরের মাংস কখন বের হবে সেই অপেক্ষা করছি। ফ্রিজ নষ্ট হওয়ায় তার মেজাজ এমনিতেই তিরিক্ষে , তারপরেও একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনেই বিরতি দিলেন। কিছু পোঁটলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিকটাত্মীয়দের বাসায় ফ্রিজ না সারা অবধি রেখে আসতে বললেন।
সেকালে , আমরা মাছ মাংস ডিম , আমিষের কাঙাল ছিলাম। সপ্তাহের পরপর দুইদিন শুধু নিরামিষ হলে মুখ অন্ধকার হতো। আম্মা গজগজ করতে করতে দুইভাইকে ডিম ভেজে ভাগ করে দিতেন। অথচ, অধুনা মধ্যবিত্তের ঘরে ডিম, মাছ, মাংস মজুদ থাকে সারামাসের জন্য, প্রায়শ: সারা বছরের জন্য। কিন্তু প্রাচুর্যের চাপে শিশুকিশোরেরা দৈনিক বাসায় তৈরি প্রাত্যহিক খাবারের চেয়ে ফাস্টফুডে আসক্ত। মাছেভাতে বাঙালি নাম ঘুচে যাওয়ার উপক্রম।স্বাস্থ্যচিন্তা, পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ফ্রিজে রাখা বিস্বাদ আমিষের প্রভাব পড়েছে বড়দের উপরেও। নানা কারণে অনেকেই মাংস এড়িয়ে চলেন।
বড়কন্যার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ওর প্রিয় আলু ভর্তা , ডিম ও যে কোন ধরণের সবজি। ঢেঁড়স সবচেয়ে প্রিয়। মুরগির মাংস কদাচিৎ মুখে তুললেও গোমাংস দেখলেই নাক কুঁচকায়। যেহেতু কৈশোরে পা দিয়েছে, ওর মতামতের দাম দিই , জোরাজুরি না করে, জানার চেষ্টা করি। কেন খাচ্ছে না বোঝার চেষ্টা করি। একদিন বললাম মাছমাংস না খেলে বাড়ন্ত শরীরে নানা প্রোটিন, ভিটামিনের কমতি থেকে যেতে পারে। পড়াশোনা করে বলে, উল্টো আমাকে নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে বোঝাল যে ভেগানরা পৃথিবীর জন্য অনেক উপকারী। সে বড় হলে ভেগান হবে।
গতকাল খেতে বসে বললাম, প্রাণীহত্যা বা যে কোন প্রাণহত্যা যদি খারাপ হয়। তাহলে তো সবজি খাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ। সকল উদ্ভিদের প্রাণ আছে, প্রমাণিত সত্য। সে হু হা করল। আমি বললাম, তোমার সবচেয়ে যে প্রিয় খাবার ডিম ; সেটাও খাওয়া বাদ দেওয়া উচিৎ। কারণ প্রতিটি ডিম একেকটা সম্ভাব্য মুরগি অথবা মোরগ।
আমরা একটা দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্যদিয়ে কৃষিতে থিতু হয়েছি। ছিলাম তো একসময় মাংসাশী শিকারির দল। আর প্রাণিজগতে ফুডচেইন বা খাদ্যশৃংখলে একজন আরেকজনের উপর নির্ভরশীল। এখানে এক প্রজাতি আরেক প্রজাতির খাবার বলেই না শৃঙ্খলা আছে। আর শুধুমাত্র খাবারের জন্য চাষাবাদ করে যে মাছ মাংস উৎপাদন করা হচ্ছে সে গুলো খেলে সমস্যা কোথায়, সেটাই দুর্বোধ্য !
অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস যার যার। কিন্তু একজন আমিষাশী মানুষ খারাপ আর আপনি নিরামিষাশী বলে ভাল মানুষ হয়ে গেলেন , সেটা কিরকম কথা ! প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিঃশ্বাসে কোটি ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস ও অণুজীব ঢুকছে, কেউ বেঁচে থাকছে, কেউ মরে যাচ্ছে। তো, এদের জীবনরক্ষার্থে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে ?
প্রতিবছর কোরবানির ঈদ এলেই প্রাণীহত্যা নিয়ে আহা উঁহু করাটা আমার কাছে বড্ডো আদিখ্যেতা মনে হয়। সারাবছর তো ডিম,দুধ, মাছমাংস খেলেন ; এখন কোরবানির বিরোধিতা করে সারাদেশের এতোবড় একটা অর্থনৈতিক চক্রকে তুচ্ছ জ্ঞান করার কী আছে !
আমার বয়স অর্ধশতকের কাছাকাছি। গোমাংস ও সকল লোহিতমাংস ( রেডমিট) খাওয়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমি কম খাই বা বেশি খাই সেটা আলোচ্য নয়। আমার বিশ্বাস পশু কোরবানির এই ট্রেন্ড ধর্মীয়দৃষ্টিতে যতোটা যৌক্তিক , অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে সেটা আরো বেশি যৌক্তিক। পুরো কোরবানিকে ঘিরে লক্ষলক্ষ পরিবারের পশুপালন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভাগ্য জড়িত।
কোরবানি দিন এবং দিন কয়েক কবজি ডুবিয়ে খান।
সবাইকে ঈদ মোবারক। ঈদের শুভেচ্ছা ।
প্রকাশকালঃ ৩১শে জুলাই,২০২০
সাম্প্রতিক মন্তব্য