দৃশ্যপট ১:
আশির দশকে ঢাকা থেকে পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোতে যাওয়ার সহজলভ্য রুট ছিল ঢাকা-আরিচা-গোয়ালন্দ হয়ে যাওয়া। আব্বা-আম্মার সাথে নানাবাড়ি যাচ্ছি–শৈশবের সবচেয়ে মধুর স্মৃতির একটা। লঞ্চের ভেঁপু, ঘাটের হোটেলে আব্বার সাথে বড়মাছের পেটি দিয়ে ভাত খাওয়া। হোটেলের সামনে বিশাল অ্যালুমিনিয়ামের থালায় রাখা টকটকে রঙের তরকারি। ঘাটের হোটেলের মেসিয়ারগুলোও কী যত্ন করে আমাদের বসতে দিত, প্লেট এগিয়ে দিত; শিশু হিসাবে নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হত।
খাওয়া শেষে গোয়ালন্দ স্টেশনে কুষ্টিয়া-গামী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। ট্রেন শুরু হলেই সেই আঞ্চলিক টানের হাতি-ঘোড়া মারা চিৎকার চেঁচামেচি। এখন চীনাবাদাম তো একটু পরেই ঝালমুড়ি, তারপরে সিদ্ধ ডিম। ‘এই চানাচ্চুর’ শুনে আবার খাওয়ায়। রাজ্যের হিজিবিজি খাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা ঐ সময়টিতে।
দৃশ্যপট ২:
নদীর গতিপথের পরিবর্তনে ফেরিঘাট আরিচা থেকে সরতে সরতে পাটুরিয়াতে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তন হয়নি শুধু দরিদ্র চেহারার ফিনফিনে দাঁড়ির কিশোর ছেলেদের মসজিদ বা মাদ্রাসার জন্য চাঁদা তোলাটা। ঘাটের মোড়ের জ্যামে গাড়ী থামলেই , চাঁদার রশিদ বই হাতে এক বা অধিক দরিদ্র চেহারার মুসল্লি সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
সম্ভবত: আরিচা ঘাটের একটা নির্দিষ্ট মোড়ে আমি বছর বিশেক ধরে ছোট একটা মাইক দিয়ে মসজিদের চাঁদা তুলতে দেখেছি। আদৌ মসজিদ হয়েছে কীনা জানিনা। হয়তো বাঁশের ছাপড়ার একটা মসজিদ হয়েছে , হয়তো হয়নি ; কিন্তু আমি জানি, চাঁদার বড় অংশটাই ব্যয়িত হয়েছে পার্থিব ক্ষুন্নিবৃত্তির কাজে।
দৃশ্যপট ৩:
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরের একপ্রান্তে , মিরপুরে । কালেভদ্রে গ্রামে নানার বাড়ী। ফিনফিনে দাঁড়ির কিশোর বা বড় দাঁড়ির যুবকদের প্রাদুর্ভাব গ্রামেই বেশী ছিল। নতুন যে হুজুরটি সম্মানের সাথে বৈঠকখানায় আপ্যায়িত হচ্ছেন , সে হয়তো বছর দশেক আগেও আমার ছোটমামার স্কুলের সতীর্থ ছিল। এখন সে সবার আখিরাতের হেফাজতের পরামর্শ দিয়ে থাকে। ঐ দিকে ঢাকায় আমাদের বাসার পাশেই ছিল মসজিদ ও লাগোয়া কওমি মাদ্রাসা। বেশ অনেকবছর ধরে মহল্লার বাসাগুলো থেকে রোস্টার পদ্ধতিতে সপ্তাহের একদিন করে করে মসজিদের ইমামকে খাবার দাবার পৌঁছে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। নিজেরা যাই খাই না কেন, ইমাম-সাহেবের জন্য ঠিকই আম্মা আঁচলের বাঁচিয়ে রাখা টাকা বের করে মুরগীর ঝোল করে খাওয়াতেন। ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’ আর ‘ধর্মভীরু মুসলমান’। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে বড় ধরণের তফাৎ আছে। আমাদের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন ‘ধর্মভীরু মুসলমান’ !
পবিত্র আরবী ভাষা শিক্ষার জন্য আমাকেও মহল্লার মাদ্রাসায় যেতে হয়েছে ! কিন্তু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আলিফ জবর আ, বে জবর বা করে করে আমপারা পর্যন্ত আসতে আসতেই বোর্ডের বৃত্তি পরীক্ষা চলে আসল। আমার পবিত্র ভাষা শিক্ষার ওইখানেই সমাপ্তি। পাশাপাশি বসে আরবী পড়ার সময় আমার মাথায় যখন টম অ্যান্ড জেরী, থান্ডার ক্যাটস ঘুরতো ; আমার পাশে বসা নিম্নবিত্ত অপুষ্ট ছেলেটার মাথায় হয়তো তখন ঘুরতো দুপুরের খাবারের চিন্তা ,মাদ্রাসার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা গরমমসলা তরকারির গন্ধ। একটা অনতিক্রম্য সামাজিক-আর্থিক-মানসিক দূরত্বে বেড়ে ওঠা আমাদের।
উচ্চ-মধ্যবিত্ত কাছের এক বন্ধুর দুইভাই-দুইবোনের সবচেয়ে ছোটভাইটিকে মাদ্রাসায় দেয়া হয়েছিল। যথারীতি ব্যবসায়ী বাপ-দাদার আখিরাতের সুরাহা করার আশায়। ঘরোয়া নানা উৎসবে ছোটভাইটি আমাদের সঙ্গে সব ব্যাপারে তাল মিলিয়ে চললেও ওর সেই সাদা জোব্বা আর দাঁড়ি নিয়ে কোথায় যেন একটা দূরত্ব থাকত ! দিনে দিনে সেটা বেড়েই গেছে আর কমেনি !
মূল প্রসঙ্গে আসি।
মাদ্রাসার ব্যাপারে আমার কোন বিদ্বেষ ছিলনা বা নেই। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘লালসালু’ র সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে কেন জানি মনে হয়েছে বাংলাদেশে ধর্মের আধ্যাত্মিকতা বা স্পিরিচুয়ালিটির চেয়ে এর ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবসাটা অনেক বেশী শক্তিশালী । গরীব ঘরের ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়ার সুযোগ পেলে অন্তত তাঁর নিজের খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকে না। এমনকি মধ্যবিত্তের যে ছেলেটি স্কুলের পড়াশোনায় একটু দুর্বল তাকেও আর আখিরাতের লোভে মাদ্রাসায় দিয়ে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল।
আমার কাছে মনে হয়েছে এই ফিনফিনে দাঁড়ির হুজুরদেরকে সামাজিকভাবে খাইয়ে দাইয়ে আমরা একটা ভিক্ষুকশ্রেণিই তৈরি করে চলেছি। কোনরকম কায়িক পরিশ্রম ছাড়া শুধু ধর্মীয় অনুশাসন- আচারের চর্চা বজায় রাখার জন্য , সমাজের এতো বড় একটা কর্মক্ষম অংশকে আমরা অকর্মণ্য পঙ্গু করে চলেছি। এই ভিক্ষাবৃত্তি আমার ভালো লাগেনি কখনোই।
এই মধ্য যৌবনে এসে জঙ্গিবাদের উত্থান বা হেফাজতের উত্থানে আমি মর্মাহত হয়েছি। আমার ভিতরে কিছুটা বিতৃষ্ণা এসেছে, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই । বহুবছর ধরে আমাদের বাড়ির কোরবানির চামড়ার টাকা মহল্লার মাদ্রাসায় দেওয়া হত।গত বছর পাঁচেক আগে থেকে আব্বা-আম্মা বেঁচে থাকতেই তাঁদের অনুমতিক্রমে সেটা এখন দেওয়া হয় দরিদ্র আত্মীয়দের।
আমার সহকর্মীর সাথে বহুদিন আগে কথা হচ্ছিল আমাদের এই অনুৎপাদনশীল কওমি মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের জনগোষ্ঠী নিয়ে। সহকর্মী তাঁর শিক্ষক পিতার প্রসঙ্গে কথা উঠলে চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন, মনে গেঁথে আছে। সহকর্মীর বাবা দীর্ঘদিনের মফঃস্বলের শিক্ষকতা ও মাদ্রাসা-শিক্ষিত মৌলভিদের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলার দারুণ একটা সমাধান বলেছেন। আমার ভালো লেগেছে। আমি জানি তাঁর এই মতের সাথে অনেকে দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বহুভাবে বলেও কওমি মাদ্রাসায় আধুনিক শিক্ষার কারিকুলাম কোন সরকার এস্টাব্লিশ করতে পারেন নাই। চারিদিকে যে ধর্মীয় আবহাওয়া বেড়ে উঠছে ভবিষ্যতেও সেটার কোন সম্ভাবনা দেখছিনা।
সহকর্মীর শিক্ষক বাবা একটু রিভার্স চিন্তা করেছেন ।
আসলে এই মাদ্রাসার হুজুর ও ইমামদের উপরে আমাদের সামাজিক ধর্মীয়-জীবন কতখানি নির্ভরশীল, কোথায় কোথায় তাঁদের ছাড়া চলেই না সেটা তিনি আগে চিহ্নিত করেছেন।
মৃতব্যক্তির দাফন ও জানাজা।
আপনি কম বা বেশী ধার্মিক যাই হোন না কেন , মৃত্যু আপনাকে বাধ্য করবে ধর্মের হেফাজতকারীদেরকে ডেকে আনতে। কারণ আপনি মুসলমান হলেও আপনার কোন ব্যবহারিক জ্ঞান নেই দাফন-কাফনের। সুতরাং মৃত্যুর এই বিষাদময় উৎসবে এঁদের বিকল্প নেই। পুরো প্রক্রিয়াটিতে, গোসল করানো, কাফন পড়ানো, কবরে নামানো, কুলখানির দিনের দাওয়াত। পরবর্তীতে কোরআন খতম, ফকির-মিসকিন আত্মীয়দের খাওয়ানো, দোয়া করা প্রতিটা ক্ষেত্রেই এঁদের সরব উপস্থিতি, অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। আপনাকে নত হতে হয়, আপনার চিরপ্রস্থানকারী পিতা মাতার আখিরাতের সুরাহা করতে হয়।
কিন্তু আপনি যদি এই প্রক্রিয়াটি নামাজ শিক্ষার মতো স্কুলেই শিখে ফেলতেন?
আপনার জন্য ব্যাপারটা অনেক সহজ হত না ? আপনি তাসবীহ রুকু পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারছেন আর এইটা শিখতে সমস্যা কি? এটা তো আমাদের মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য একটা সমাপ্তি।
আর আছে, কোরবানি দেওয়া, নামাজের ইমামতি করা , মিলাদ পড়ানো, মৃতব্যক্তির আত্মার শান্তিতে মোনাজাত করা ইত্যাদি।
এখন , বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ইসলাম ধর্ম শিক্ষা আছে দশম শ্রেণী পর্যন্ত।
সেখানে, ১০০ নাম্বারের পুরোটাই লিখিত না রেখে। ৫০ নম্বর ব্যবহারিক রাখা হোক।
কীভাবে মৃতব্যক্তিকে গোসল করাতে হবে, কীভাবে জানাজার নামাজ পড়াতে হবে, কোরবানি কীভাবে করতে হবে, নামাজের ইমামতি কীভাবে করতে হবে সবকিছুর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকুক।
সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন এই ধর্মের ব্যবহারিক অনুশাসন ও আচারগুলো ভালোমতো প্র্যাকটিস করবে, তখন এই অনুৎপাদনশীল মাদ্রাসা শিক্ষিতদের উপরে নির্ভরতা কমে যাবে। ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হোক এই জাতি।
কেননা আমাদের যেতে হবে অনেকটা পথ !
[ প্রকাশকালঃ ৩১শে আগস্ট,২০১৬ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য