আমাদের জনপ্রিয় এক কথাসাহিত্যিক বাঙালীকে অ্যাকুরিয়ামের রাখা গোল্ডফিশের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। গোল্ডফিশ নাকি অ্যাকুরিয়ামের একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে যেতে ভুলে যায় খেয়েছিল কীনা। খায়, হজম হয়ে , যায় , ত্যাগ করে আবার খায় ! এদের স্মৃতিশক্তি ৩ সেকেন্ডের কাছাকাছি। তথ্যের আদৌ কতখানি বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যতা আছে সেটা খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে !
সপ্তাহ দুয়েক ধরে দাবদাহ চলছে পুরো দেশের উপর দিয়ে । আমি আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করছি। গত বছর না হলেও বা তার আগের অনেকগুলো বছরেই ঠিক এইরকমই বা এর চেয়ে বেশি গরম ছিল। বছর দশেক আগে আমাদের রুটিন করে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ আরেক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হত। সারারাত হাতপাখা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে ভোররাতে ঘুমিয়ে শ্রান্ত হয়ে অফিসের দিকে ছোটার অভিজ্ঞতা মনে আছে অনেকের ! কিন্তু এই কয়েকদিনে সেই দুর্বিষহ সময়ের কথা আমরা দিব্যি ভুলে বসে আছি।
ছোটবেলায় প্রতি ঈদের জামাতে গিয়ে নতুন করে অতিরিক্ত তিন নাকি ছয় তাকবীরের পরে হাত বাঁধতে হবে, রুকুতে যেতে হবে সেটা ভুলে যেতাম আর নতুন করে ইমামের কাছে শিখতাম। অথবা ডানে বামে মুরব্বী কাউকে অনুসরণ করতাম। ইমাম সাহেবরাও ব্যাপারটা বুঝেই নামাজ শুরুর আগে উচ্চস্বরে নামাজের নিয়ম সবাইকে মনে করিয়ে দিতেন।
অনেকগুলো দুর্বিষহ গরমের মাঝে কয়েকটি মনে করার চেষ্টা করলাম। স্কুল জীবনে ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় স্কুল বন্ধের আনন্দ মাটি হয়ে গেল গরমের যন্ত্রণায়। পুরো ঢাকা জলাবদ্ধ ; বিদ্যুৎ নেই ; চারপাশের ভ্যাঁপসা গরমে নাভিশ্বাস। কোন আশার খবর নেই ; কবে আবার আমরা ফিরে যেতে পারব আমাদের স্বাভাবিক জীবনে। গরম, মশা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সব মিলিয়ে সে এক অকথ্য অভিজ্ঞতা। রাতের পর রাত খোলা ছাদে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়েছি আমরা। ঠিক কিছুদিন পরেই আমার দুর্ভাগ্য হয়েছিল ঢাকার কোর্ট প্রাঙ্গণের হাজতখানা দেখার। একটা ২০ ফুট বাই ১০ ফুট রুমে চার-পাঁচটা থানার ধৃতদের থাকতে হত। মোটামুটি শ’ দেড়েক লোকের জন্য একটা মাত্র টয়লেট। আর ভেন্টিলেশন নেই বললেই চলে। একজনের গায়ের সঙ্গে আরেকজন লেগে আছে। এমন নারকীয় গরম যে মানুষের ঘামগুলো বাষ্পীভূত হয়ে আবার দেয়াল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল !
এর পরে কলেজ পেরিয়ে টেক্সটাইল বিদ্যাঙ্গনে । আমি নিজে প্রতিটা গরমের সময়ে আম্মার সাবধান বানী শুনে ঠিক সময়ে দুপুরে খাবার খেতাম ; পানি খেতাম বেশি করে ! আম্মা আমাদের গরমের সময়টিতে যাতে হুট করে অসুস্থ হয়ে না পড়ি, সে জন্য নানাভাবে সাবধান করতেন। তাছাড়া ওই সময়টাতে ভরদুপুরের বাইরে বাইরে খেলাধুলা করার বয়সটাও পেরিয়ে এসেছিলেম। বড় ভাইয়াও তাই। কিন্তু আমাদের গুণধর ছোট ভ্রাতাটি তখনো দুষ্টুর শিরোমণি বাউণ্ডুলে ; আগারে পাগারে ঘোরা ফেরা করে ,নাওয়া খাওয়ার ঠিকঠিকানা নেই। সে যথারীতি কোথা থেকে যেন চিকেন পক্স বাঁধিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমে তিনদিনের মাথায় সেরে উঠলো সে , ওর পরে বড় ভাইয়া ~ সে ভুগল এক সপ্তাহের মতো। অবশেষে বাড়ীর শেষ অভিযাত্রী হিসাবে আমার জীবনে বসন্ত এলো। মে-জুনের বিভীষিকাময় গরম। আর আমার রুমের ছাদ ছিল টিনের। সকাল না গড়াতেই চিটচিটে গরমে বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র উষ্ণ হয়ে উঠত। আমার মাথা, পিঠ , সারা শরীর জুড়ে টসটসে ফোস্কার মতো পক্স। আমি সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতাম আর যাকে ইচ্ছে তাকে অভিশাপ দিতাম। সেই অভিসম্পাতের বেশির ভাগ আমার অনুজের দিকেই ধাবিত হত।
পরের কিছু বছরে দিল্লী~রাজস্থানের মরুময় গরমে কাবু হয়েছি, সেই উষ্ণতার কথা ভোলার নয়। লূ হাওয়ার ঝাপটা শরীরের অনাবৃত অংশের চামড়া জ্বলিয়ে দেয় ; ঠোঁট ফেটে যায়, যেখানে যেখানে রোদ পড়েছে গায়ের চামড়ার এক স্তর উঠে যেতে থাকে ।গতবছর চেন্নাই-এর গরমেও কাহিল হলাম। চার~পাঁচ দিনের সফরে দিনের বেলায় বাইরে খুব কম যেতাম। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে মোটর বাইকের মেয়েদের পুরো মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকা দেখে আমার সহধর্মিণীর ধারণা হয়েছিল এখানে বোধহয় মুসলমানদের প্রাধান্য। কিছুক্ষণের ভিতরেই বাতাসের ভয়াবহ উষ্ণ ছোবলে বোঝা গেল কেন সকলেই হাত মুখের সমগ্র অংশ ঢেকে রেখেছে।
যাই হোক পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দিন কয়েক পরে এক পশলা বৃষ্টি আমাদের এই দুর্বিষহ গরমের কথা ভুলিয়ে দেবে। আবারো ২০১৮ বা ১৯ সালের দাবদাহে ভাজা ভাজা হতে হতে আমরা ভুলেই যাব ১৭ সালের মে-জুনে কী ভয়াবহ সময়ই না আমরা কাটিয়েছি।
এই যে জাতি হিসেবে আমাদের ভুলে যাওয়ার সক্ষমতা সেটি আমাদের ‘দুর্বলতা’ নাকি ‘শক্তিমত্তা’ সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে বৈকি !
প্রকাশকালঃ মে, ২০১৭
সাম্প্রতিক মন্তব্য