বহুবছর আগে পড়েছিলাম। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প সংকলনের নাম ছিল ‘মাপা হাসি চাপা কান্না’।

আজ বিকালে বসে ভাবছিলাম– শিক্ষিত বাঙালি মেপে হাসে কেন ? হাসলে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বুদ্ধি বের হয়ে যাবে বলে কী কম হাসে অথবা হাসতেই চায় না। লক্ষণীয় যে, লেখক ও মানুষ হিসাবে যারা কৌতুকপ্রিয়, হাসিখুশি, সমাজে তাদেরকে খুব একটা উঁচু চোখে দেখা হয় না। এই যেমন আমাদের সামগ্রিক সাহিত্য , সিনেমা ও নাটকের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় অনানুষাঙ্গিক চরিত্রটি হচ্ছেন তিনি, যিনি ফিলার হিসাবে গল্পে টিকে আছে আছেন কোনরকমে। তিনি – যিনি নাটক, সিনেমার মাঝেসাঁঝে কৌতুক করছেন, লোক হাসাতে চাচ্ছেন, বিনোদিত করতে চাচ্ছেন।

পাশ্চাত্যে চার্লি চ্যাপলিন একজনই ছিলেন।

আমাদেরকে খুঁজে পেতে একজনের কথাই মনে পড়বে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রয়াত খান জয়নুল, আশীষ কুমার লোহ, আনিস, হাসমত, টেলিসামাদ, দিলদার ও নাম না জানা অনেকেই সারাজীবন পার্শ্বচরিত্রেই ছিলেন। প্রোটাগনিস্ট বা মূল অভিনেতা হতে পারেননি কখনো, কোন পরিচালক সেই সুযোগ করে দেননি।
চলচ্চিত্রে কেউ চরিত্রাভিনেতা হতে না পারলেও, নাটকে আশির দশকে আমজাদ হোসেন সেটা করতে পেরেছিলেন। সেই সময়ের ঈদের নাটকে ‘জব্বর আলী’ ছিলেন একজন সামাজিক টাউট, আদম-ব্যবসায়ী, মজুতদার। তাঁর নানা কীর্তিকাণ্ড ও ধরা খাওয়ায় দেখে দর্শক হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। জব্বর আলী নতুন কী কাণ্ড করে জেলে গিয়ে ঈদের সেমাই খাবে, সেটা দেখার জন্য প্রতি ঈদে আমরা বিটিভির সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও সিনেমায় তাঁর জাদুকরী গল্প আর মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার কাব্যই ছিল মূল চরিত্র। একজন শান্তশিষ্ট বোকাবোকা বাবা, খুব কড়া মেজাজের মা ; তরল কথা বলা দেবর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তায় পটু কাজের লোক ; ভীরু প্রেমিক ও সাহসী প্রেমিকা নিয়ে তাঁর ঈদের নাটকগুলো ছিল অসম্ভব স্বাদু। কিছু নাটক নিখাদ আনন্দের, কিছু নাটকে প্রচ্ছন্ন সমাজ সচেতনতার মেসেজ।

হুমায়ূন আহমেদ জীবিতাবস্থায় তাঁর লেখালেখি দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকের মন জয় করতে পারলেও, সমালোচক ও সাহিত্য-বোদ্ধারা তাঁর পুরো লেখালেখিকেই হালকা করে দেখেছেন। কেউ কেউ জিজ্ঞেসও করেছেন, কেন তিনি সিরিয়াস লেখা লেখেন না।

আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করছি, সিরিয়াস লেখা কয়জন পাঠকের কাছে যায়। কমলকুমার মজুমদার কি অধিক পঠিত? বিষ্ণু দের কবিতা কয়জন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে? শরৎচন্দ্র , মানিক, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শিবরাম চক্রবর্তী, সুনীল , সঞ্জীব, সমরেশ, শীর্ষেন্দু জনপ্রিয় বলে কি তাঁরা সিরিয়াস সাহিত্যিক নন ? দুই-বাংলা তন্নতন্ন করে আমাদের একজনই সৈয়দ মুজতবা আলী আছেন ; যার অসম্ভব উইট সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, উপন্যাস, সবধরনের লেখালেখি এক ফরমেটে ‘রম্যরচনা’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সরস, চটুল, হালকা ভঙ্গীর লেখালেখিকে , কথা বলাকে এতো তাচ্ছিল্য কেন বাঙালির ! নাকি , ছোটবেলা থেকে “ যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রাম সন্না” শুনে শুনে বড় হওয়া বাঙালি অবচেতনে ধরেই নিয়েছে, হাসি ব্যাপারটা মোটেও ভালো কিছু না, হাসি হচ্ছে কান্নার প্রারম্ভিকতা। আর তাছাড়া আমরা শৈশবে দেখেছি, মন খুলে হো হো হাসির হুল্লোড় উঠলেই , চারপাশ থেকে বিশেষ একশ্রেণীর আত্মীয়, মুরব্বী হা রে রে করে ছুটে আসত, ‘এতো হাসি কীসের ! কপালে দুঃখ আছে !’

হ্যাঁ, রে ভাই, হাসির পরে দুঃখ আছে বলে কি আমাদের মেপে মেপেই হাসতে হবে। দুঃখ তো হাসলেও আসবে ; না হেসে সুকুমার রায়ের রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকলেও আসবে। জীবনযাপনের প্রাত্যহিক যন্ত্রণা, প্রিয়জন হারানোর শোক, দুঃখ, বেদনা, নানাবিধ ব্যর্থতা, চাওয়া না পাওয়ার টানাপড়েন, শারীরিক অসুস্থতা, বার্ধক্য আর অবশেষে অনিবার্য মৃত্যু তো আপনার হাসির তোয়াক্কা করে না। তবু, কেন এতো চাপা কান্না, বেদনার উদযাপন, শোকের উদযাপন ! বাঙালি মনুষ্যের আকাশে সারাক্ষণ চাপাকান্নার মেঘলা আবহাওয়াই থাকবে কেন ! গম্ভীর হয়ে, সিরিয়াস হয়েও নিয়তিকে কী কেউ এড়াতে পেরেছে ! পারেনি ; পারবেও না।

বাঙালির জীবনে হাসির সূর্যালোক দূর করুক সব অপ্রাপ্তির , বেদনার কালো মেঘ।
হে বাঙালি ! হাসতে হাসতেই না হয়, নিয়তির সঙ্গে লড়াই করা শিখুন !

প্রকাশকালঃ ২৮শে অক্টোবর,২০২০