গার্মেন্টস নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকজন ক্রেতা ও মালিকপক্ষের বিচ্ছিন্ন মন্তব্য ও মতামতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরছি। আমি এইখানে কোন পক্ষ অবলম্বন করছি না। আমি চাই, গার্মেন্টস ট্রেড থাকুক, প্রফেশনাল মালিক , শ্রমিক ও কর্মচারীরা কাজ করুক। কতিপয় অর্থগৃধ্নু মালিকের ও ক্রেতার জন্য সবাইকে দোষারোপের চলতি হাওয়া থেকে বের হয়ে আসুক মিডিয়া। যে কয় ডলারের ব্যবসাই করেন না কেন, ভালো পরিবেশে উন্নত শ্রমিকবান্ধব কারখানায় করেন।

ভাইরে, আমার আকাংখা দিয়ে তো আর বাংলাদেশ চলে না, তাই অন্যদের কিছু মন্তব্য শুনিঃ

ক্রেতাদের কিছু মন্তব্যঃ

১। বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকের মতামত– আমারাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সস্তা শ্রমের দেশ । আমরা অপরিহার্য, চীনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার আমরা ছাড়া পশ্চিমা ক্রেতাদের যাওয়ার কোন জায়গা নাই। ক্রেতাদের কথা –কিন্তু, একটা কথা সবাই ভুলে যাচ্ছো, পৃথিবীর মোট বস্ত্রচাহিদার ৪ থেকে ৫ শতাংশ মাত্র বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ২১/২২ বিলিয়ন ডলারের বাজার।

কথা সত্য , একক দেশ হিসাবে তোমরা চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম। কিন্তু , ঐ যে বলেনা, বিশাল ব্যবধানে দ্বিতীয়, তোমরা তাই।

তো, কিছু বড়ো ক্রেতার অবস্থান অনেকটা এইরকম, ‘ বাংলাদেশ নিজেরে অপরিহার্য ভাইবো না। আমরা যদি ৯৫% বস্ত্র অন্য দেশ থেকে সোর্সিং করতে পারি। তোমাদের ৫% অন্য কোথাও থেকে ঠিকই আমরা ম্যানেজ করে নিব।’

ডাটা স্ট্যাটিস্টিক্স দিয়ে পোস্ট ভারি করবো না, কেউ উৎসাহী হলে, গুগলে যাইয়া দেখেন।

২। প্রতি পিস টি-শার্টে তোমাগো আরো দশ সেন্ট দিলে নাকি তোমরা শ্রমিক কল্যানের সব কিছু কইর‍্যা ফালাইব্যা । তোমাদের মতো দুর্নীতিবাজ জাতির পক্ষ থেকে কে গ্যারান্টি দেবে যে, ঐ অতিরিক্ত ১০ সেন্ট শ্রমিকের কল্যানেই লাগাইবা, নাকি হুদা মিছা মালিক ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের লাভের পরিমাণ খামোখা বাড়াইবা। শ্রমিক যেইখানে ছিল সেইখানেই থাকবে।

৩। যেকোন বস্ত্র উৎপাদনকারী দেশেই বছর তিরিশেক পরে শ্রমঘন ভারী বা লোটেক শিল্প থেকে হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনে গেছে। তোমাগো অবস্থা যা, তোমরা আরো তিরিশ বছরেও হাইটেকে যাইতে পারবা না ! তাইওয়ান, কোরিয়া, চায়না, শ্রীলংকা , মেক্সিকো যে দেশেই এই গার্মেন্টস শিল্প ছিল তারা তাঁদের প্রথম ৩০ বছর পরে কোথায় আর তোমরা কোথায় !

৪।মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ক্রেতা হিসাবে আমি আমার সর্বোচ্চ গুণগতমান সর্বনিম্ন খরচে চাইব। তোমার এখানে না পেলে অন্য জায়গায় যাবো। এখন তোমার দ্বায়িত্বই বেশী নিজস্ব ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও কমপ্লায়েন্স করার জন্য তোমাদেরকেই ঠিক করতে হবে কীভাবে শ্রমবান্ধব পরিবেশে গার্মেন্টস উৎপাদন করবা।

আমার নিজের কথা, নতুন পে স্কেলে শ্রমিকের বেতন ৫০% বাড়লেও আমি মনে করি, তারপরেও বাংলাদেশ গ্লোবাল মার্কেটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

মালিকপক্ষের বিচ্ছিন্ন কিছুকথা:

১।ভাই, গত তিরিশ বছরে সড়ক ও লঞ্চ দুর্ঘটনায় কতোজন মারা গেছে আর এতোবড় একটা গার্মেন্টস শিল্পে কতজন মারা গেছে, একটু কাইন্ডলি কম্পেয়ার করেন। একতরফা একটা দুইটা দুর্ঘটনা দিয়ে পুরো ট্রেডটারে কালপ্রিট বানাইয়েন না।

২।গাঁটের টাকা খরচ করে, বউয়ের গহনা বিক্রি করে, বাড়ি জমি বন্ধক রেখে ১৮ থেকে ২০% ব্যাংক ইন্টারেস্টে ব্যবসা করতে আসছেন। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের কথা যদি বলেন– ব্যবসার অন্যতম উদ্দেশ্যতো মুনাফা , নাকি ? ব্যবসায় যদি মুনাফা না থাকে শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলেন, তাইলে আপনারাই ব্যবসায় নামেন। সামাজিকতা করেন , চ্যারিটি করেন। বছর শেষে ব্যাংক লোন শোধ করতে হবে , মুনাফা করতে হবে আবার অদক্ষ শ্রমিকের জন্য সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিতে হবে। ভালো , ভালো না !

৩।গ্রামের একটা অশিক্ষিত, বা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিক কোন প্রাথমিক ট্রেনিং ছাড়া এসে বসে যে পারিশ্রমিক পাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্য কোন সেক্টরে মনে করেন, চিংড়ী ঘেরে, কৃষিকাজে, দিনমজুরী করে, ঘরামী করে, যদি এর চেয়ে বেশী পাইতো, তাইলে কি তারা গার্মেন্টসে কাজ করতে আসতো ? সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাচ্ছে বলেইতো তারা এই সেক্টরে !

আবার ডিমান্ড সাপ্লাই চেইন মেনে, শ্রমিকের প্রতুলতা ও অপ্রতুলতাই তাঁদের মজুরী কতো হবে ঠিক করে। আমরাতো শিকল দিয়ে বাইন্ধা রাখি নাই, পোপের মতো কথা বললেতো হবে না। ৫শ টাকা বেশী পাইলে, মালিকের কোন হ্যাডাটা ঠিক রাখতেছে শ্রমিকেরা। ঠিকইতো অন্য আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছে।

দক্ষতার কথা বলেন, চীনা একটা শ্রমিক যে দক্ষতা নিয়ে কাজ করে , তার ৩০% দক্ষতাও আমাদের বেশীরভাগ শ্রমিকের নাই। ওদের বেতন বেশী হবে নাতো কী আমাদের রোকেয়া কুলসুমের বেতন বেশী হবে !

৪। সরকার , মিডিয়া সবাই বাংলাদেশের আর কোন শ্রমিকদের জন্য বছরে বছরে আপনারা বেতন বাড়াচ্ছেন বা বেতন বাড়ানোর জন্য প্রেসার দিচ্ছেন ? অন্যরা কী কি দোষ করছে। বৈষম্যতো আপনারাও করছেন। এখন গার্মেন্টসের শ্রমিকের বেতন ৮০০০ টাকা দিলে অন্য সব সরকারী বেসরকারী শ্রমিকেরা কী দোষ করলো। অন্য সব সেক্টরের শ্রমিকের বেতনও বাড়াতে হবে।

শ্রমিকের বেতন ৫০% বাড়াইলেন। সঙ্গে সঙ্গে কী হবে জানেন। বাড়ীভাড়া বাড়বে, খাদ্যের দাম বাড়বে, বাসভাড়া বাড়বে , বেকারীর দাম বাড়বে, ডিমের দাম বাড়বে। বাড়তি টাকার পুরোটাই অন্যের পকেটে যাবে। মুদ্রাস্ফীতির দায় শুধু মালিকদের উপর চাপাচ্ছেন কেনো?

সুশীল সমাজের একজন বললেন, তিরিশ বছরে গার্মেন্টস মালিকেরা সরকারকে কি দিয়েছেন। ২৫% ইনসেন্টিভ নিছেন। সারাক্ষণ গ্যাস বিদ্যুৎ নিয়ে চাপাচাপি করছেন। ট্যাক্স দিছেন কতো? কিছু কইলেই, কর্মসংস্থানের দোহাই দিয়ে আরো সহযোগিতা করতে বলেছেন। যে পরিমাণ ট্যাক্স ফাঁকি দিছেন, ওইটা দিয়া আরো হাজার খানেক ইপিজেড তৈরী করা যাইতো। কর্মচারী আমরা যারা, কয়জন ঠিকমতো ট্যাক্স দিই। বছরের মে-জুন মাস থেকে দৌড়াদৌড়ি ক্যামনে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়।

তবে, উপরের সবকটা মন্তব্যেই আমার পরিচিত কোন না কোন ক্রেতা বা মালিক করছেন।আমি মনে করি , শ্রমিক, মালিক,ক্রেতা , সরকার ও বিরোধীদলের একটা সমন্বিত প্রক্রিয়া দরকার। সমন্ব্যহীনভাবে একেক জন একেকভাবে কি কি করতে চাচ্ছেন, বোঝা মুশকিল।উল্লেখ্য, শ্রমিক পক্ষের কারো সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয় নাই, কিন্তু টিভি মিডিয়াতে তাঁদের দাবী দাওয়া অত্যন্ত স্পষ্ট। সেইটা আমরা কমবেশী সবাই জানি।