পুরনো প্রেক্ষাপটে লেখা, গত পরশুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণে কিছু সংযুক্তি করে আবার লিখছি। প্রতিটি ধর্ষণ পুরুষ হিসাবে আমার মাথা নত করে দেয়। আমার বোন, আমার কন্যা ও আমার নারী সহকর্মীদের দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারি না। প্রতিটি ধর্ষণ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি পুরুষ সমাজের প্রতিভূ , এবং আমি আরেকজন নারীর জন্য নিরাপদ নই।
ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকার ও রাষ্ট্র কি কি করতে পারে ও করা উচিৎ সেটা নিয়ে আমার আলোচ্য নয়। একদিকে বিলুপ্তপ্রায় প্রগতিশীল অংশ আরেকদিকে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে অপ্রতিরোধ্য ও বিশাল ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের মতোও আরেক জনগোষ্ঠীর মাঝে আমরা পড়েছি উভয়সংকটে।
সমাজের মল-মূত্র, স্যানিটারি ন্যাপকিন, উচ্ছিষ্টের জায়গা ডাস্টবিন। গলিত অর্ধগলিত আবর্জনা ফেলার ও পরিষ্কার করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। যার প্রয়োজন সে ফেলবে, যাদের পরিষ্কার করার দরকার সে একটা সময়ে এসে পরিষ্কার করবে। যে বা যারা দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারে না, তাঁরা অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের জীবনের অতি অপরিহার্য এই নোংরা ময়লা ফেলানোর জায়গাটা যেন নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে পুরো মহল্লায় ও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়াতে না পারে। নির্দিষ্ট জায়গা না থাকলে আপনার ব্যবহার করা কনডম ঝুলবে পাশের বাড়ির কার্নিশে । আপনার কাজের বুয়া সবজির উচ্ছিষ্ট ফেলবে আপনার সামনের সুন্দর সাজানো বাগানে !
ময়লা খারাপ , দুর্গন্ধ খারাপ এই অজুহাতে তো ডাস্টবিন তুলে দেওয়া যাবে না। নাকি, আমরা সবাই ইউটোপিয়া নামের কল্পরাজ্য বা পবিত্র গ্রন্থে বর্ণিত সেই স্বর্গরাজ্য চাই । খেলাম কিন্তু হাগুমুতু হবে না। মেশক-আম্বরের গন্ধে ভরে থাকবে সবার উজ্জ্বল দেহ !
কয়েক বছর আগে তখন বারাক ওবামা ক্ষমতায়, অফিসের ট্রাভেলে মাঝপথে দিন কয়েকের বিরতি নিয়েছি স্কুল-বন্ধুর বাসায় । ভার্জিনিয়া, আম্রিকায়। তো এক শুক্রবার সকালে বন্ধু কন্যাকে স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার সময় বন্ধুর স্বগতোক্তি ,স্কুলের পতাকা নামানো ক্যান মামা? কেউ মারাটারা গেল নাকি! নিউজ চ্যানেল দ্যাখ তো কাহিনী কি। আমি হু হা করে ইউটিউবে গান শোনায় মনোযোগ দিই । গাড়ীতে ওয়াই ফাই লাগানো। আমেরিকার পতাকা অর্ধনমিত কেন, সেটা জানা আমার প্রায়োরিটি না !
আসার পথে গ্যাস স্টেশন, অফিস, মনোহারী দোকান সবখানেই পতাকা নামানো দেখে একবার ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞাস করি। ভাগ্যিস করিনি ! বাসায় এসে দুপুরে খেতে খেতে বন্ধু-পত্নীর কথায় মনে পড়ে যায় আজ ১১ই সেপ্টেম্বর ( নাইন-ইলেভেন) ! দুজনেই বিব্রত বোধ করি।
কারো কোন তির্যক মন্তব্য বা মতামত পছন্দ হলে আমার দীর্ঘদিন মনে থাকে।
বছর পনেরো আগে মহল্লার পান-বিড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে এক বড়ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। সদ্যই টানবাজার ও কান্দুপট্টি সাফল্যের সঙ্গে উচ্ছেদ করা হয়েছে পবিত্রতার দোহাই দিয়ে ! মূলত: প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের জমি ও রাজনৈতিক দখলদারিত্বের ফাঁকে পড়ে যায় যৌনকর্মীরা । আশির দশকের শুরুতে একবার উচ্ছেদ করা হয়েছিল, নানা কারণে ধুঁকে ধুঁকে চললেও ৯৯ সালে পুরোপুরি গৃহহারা হন যৌনকর্মীরা। এরপর একে একে, নিমতলি, ইংলিশ রোড, টাঙ্গাইল সব জায়গা থেকে পতিতা-পল্লী উচ্ছেদ করা হয়।
সামাজিক গবেষণার অনেকগুলো শব্দ আছে, পুনর্বাসন, পতিতাবৃত্তি, নিরাপত্তা হীনতা ,সামাজিক অব্যবস্থা, ইসলামী অনুশাসন , দারিদ্র্য ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যেহেতু গবেষক নই, আমার চিন্তা ক্ষুদ্র একটা জায়গায় এসে ঘুরপাক খায়। উল্লেখ্য, পৃথিবীর এই আদিমতম পেশার প্রতি আমার কোন সমর্থন নেই। নিজের দেহ বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেয়ে অসম্মানের কিছু নেই।
কিন্তু শেষ বিকেলের ওই আলোচনার বিষয় ছিল, উচ্ছেদ করলেই কি নির্মূল হবে। এঁরা তো ছড়িয়ে পড়বে ঢাকা শহরের সম্ভব অসম্ভব সমস্ত জায়গায়। পরবর্তী এক যুগ আমরা দেখেছি কীভাবে পতিতাবৃত্তি নানা চেহারায় পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে, ভদ্রপল্লিতে নানা ডাইমেনশনে ছড়িয়ে পড়েছিল ।
পুঁজিবাদের কথা , গণতন্ত্রের কথা বলবেন ; আর তার উপজাত বা বাই-প্রোডাক্ট নিয়ে নাক সিঁটকাবেন ; কেমন করে হবে! সামাজিক সুস্বাস্থ্যের জন্য, পুঁজিবাদের বাই প্রোডাক্ট হিসাবে যৌন-ব্যবসা টিকে থাকবেই। বড়োজোর প্রাতিষ্ঠানিক যৌনকর্মীদের কে আপনি ভাসমান পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেবেন! এর পরে আপনি আশা করবেন আপনার ভাই-বন্ধু-পুত্ররা তাঁদের কখনই খুঁজে পাবে না ?
আপনি কথায় কথায় গণতন্ত্রের দোহাই দেবেন, আপনি আফগানিস্তানে হামলা করবেন, ইরাকে হামলা করবেন ; ফিলিস্তানিদের গৃহচ্যুতিতে ইজরাইলকে সমর্থন দেবেন। আবার আশা করবনে , আপনার নিরাপত্তা সবসময় অ-বিঘ্নিত থাকবে ! ভীমরুলের চাকে খোঁচা দেবেন, আর তারা আপনার পরিপার্শ্বের কাউকে কে হুল ফোটাবে না ? আপনি এটাকে কতোখানি গন্ডীবদ্ধ করে রাখতে পারছেন সেটা আলোচ্য ও বিবেচ্য হওয়া উচিৎ ছিল।
ধর্ম সন্ত্রাসতো হাজার বছরের পুরনো ! সভ্যতা-অসভ্যতা যতদিন থাকবে, ধর্মসন্ত্রাসও থাকবে। আমেরিকা ধর্মসন্ত্রাসীদের গন্ডীবদ্ধ না করে নিজেদেরকেই অনিরাপত্তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমেরিকা তার বাজেটের বড়ো একটা অংশ ধর্মসন্ত্রাসীদের পুনর্বাসনে খরচ করলে হয়তো, টুইন টাওয়ার ধ্বসে পড়তো না।
ইউরোপও দিনের পর দিন আমেরিকার অনৈতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সরবে ও নীরবে সমর্থন দিয়েছে। আজ তার উত্তাপ নিজের ঘরে টের পাচ্ছে তারা। শরণার্থীর ছদ্মবেশে হয়তোবা ‘আইএস’-কেও আশ্রয় দিতে হচ্ছে !
প্রতিটা এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা চেকিং পার হই আর মনে মনে বলি, আমার দেখা পৃথিবী দুই সময়ে বিভক্ত, নাইন- ইলেভেনের আগের পৃথিবী আর নাইন-ইলেভেনের পরের পৃথিবী !
অন্যদিকে, আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ পরিবার বিবর্জিত হয়ে ঢাকা নামের এক কুৎসিত শহরে দিনের পর দিন আর মাসের পর মাস পার করে। আমাদের বাড়ীর দারোয়ান, রিকশাচালক, প্রাইভেট ড্রাইভার, বাস-ট্রাক-থ্রি হুইলার চালক থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী ও নানা প্রান্তিক জনসংখ্যা।
আপনার কি মনে হয়, এঁরা যৌন তাড়না বিবর্জিত প্রাণী ? এছাড়া রয়েছে, উঠতি তরুণ, বখে যাওয়া অ্যাডিক্ট যুব সমাজ। আচ্ছা বাদ দেন, এঁদের ব্যাপারে আপনার সহানুভূতি নাও থাকতে পারে। আপনি তো ফেসবুকে দেশ উদ্ধার করা আর বাইরে ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকা সমাজের প্রিভিলেজড একটা অংশ। কেউ আছে, শারীরিকভাবে পঙ্গু, অতি দরিদ্র নারী বিয়ে করে তারপর যৌন কামনা মেটানোর অর্থনৈতিক অবস্থা সহসাই আসার সম্ভাবনা কম যাঁদের। তাঁদের এই কামনা-বাসনা রিলিজের কোন ব্যবস্থা কি রেখেছে আমাদের অতি-ধার্মিক সমাজ ?
সমাজকে যথাসম্ভব দুর্গন্ধ মুক্ত রাখতে হলে নোংরা ময়লা ফেলানোর জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছাড়া আমি তো কোন উপায় দেখি না।
প্রকাশকালঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর,২০১৫
সাম্প্রতিক মন্তব্য