কিছুদিন  আগে , ২০১৩ সালের একটা স্ট্যাটাস রিপোস্ট করেছিলাম প্রবাস জীবন নিয়ে ।

কেন জানি না , কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মর্মাহত হয়েছেন। কেউ অবলীলায় বলেছে ‘ আঙুর ফল টক’ বলেই নাকি আমি প্রবাস জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলোকে অনাবশ্যক গুরুত্ব দিয়েছি। প্রারম্ভিক ক্ষমা প্রার্থী হওয়া স্বত্বেও আমার লেখায় বিদ্রূপ ও বিদ্বেষের ছোঁয়া পেয়েছেন তাঁরা !
এটাও সত্যি সংখ্যালঘু অনেকেই প্রবাস জীবন বেছে নেওয়ার পরে আবার দেশে ফিরে আসতে চান ; কিন্তু পেরে ওঠেন না । কেন পারেন না , সেটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন ঘনিষ্ঠের সঙ্গে।

মূলত: অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আমাদের আগের কয়েক প্রজন্মের প্রবাস মুখী হওয়ার মূল কারণ । নতুন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বাঁধাগুলো আমার দৃষ্টিতে নীচের কয়েকটি ; বিদ্বজ্জনেরা আরো কিছু বের করতে সমর্থ হবেন।

১। একবার উন্নত বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে নতুন করে বাংলাদেশের অশ্লীল, কদর্য পুতিগন্ধময় পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া কঠিন । যতো দেশপ্রেমের কথাই বলি না কেন, প্রতিনিয়ত নানা অদ্ভুতুড়ে প্রতিকার হীন সামাজিক ব্যাধি ও অন্যায়ের মুখোমুখি হয়ে স্নায়ুক্ষয় করা ছাড়া উপায় থাকে না। আমার অনেক চিকিৎসক ও প্রকৌশলী বন্ধু যাঁদের গায়ে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির গাঢ় সীল নেই ; নিতান্তই রাজনীতি বিমুখ –তাঁদের কয়েকজন ছেড়ে গেছেন প্রশাসনের সহ্যাতীত অবিবেচনার জন্য। এমন না যে , তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। কিন্তু, তাঁরা ভেঙ্গে পড়েছিলেন ক্রমাগত অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ না করতে পারার মনোবেদনায়।

২। পরের সর্বগ্রাসী যে বিষয়টি আমাদের মেধাবী ও অমেধাবী সবাইকে ঠেলে দেয় পশ্চিমের দিকে তা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। পশ্চিমাদেশের তুলনায় আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা শতভাগের একভাগও নয়। একবার সেই নিরপত্তায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার মায়া কাটানো মুশকিল।

৩। আমাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ছিল, আছে এবং থাকবে । নিতান্ত নির্বোধ ছাড়া আর সকলেই অনিশ্চয়তায় ভোগে। জীবনের অনিশ্চয়তার কাটানোর অলীক কল্পনা আচ্ছন্ন করে রাখে প্রবাসীদেরকে। তাঁদের ধারণা হয়, তাঁদের জীবনের অনিশ্চয়তা অনেক কমিয়ে ফেলেছে পশ্চিমা দেশ। তবে এই অনিশ্চয়তার প্রভাব বেশি দেখা যায় আমাদের উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে।

৪। প্রথম প্রজন্মের মেধাবী অনেকেই তাঁদের অর্জিত ডিগ্রী ও মেধা নিয়ে ফিরে আসতে চান দেশে। কিন্তু তাঁদের মেধা প্রয়োগের বাস্তবিক কোন সুযোগ থাকে না। কেউ কেউ , বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তাঁর মেধার কিছুটা বিলিয়ে যেতে পারেন। অন্যদের বাধ্য হয়েই পশ্চিমাদেশের শিক্ষায়তনে ও ইন্ডাস্ট্রিতে দিনাতিপাত করতে হয়।

৫। দ্বিতীয় প্রজন্মকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব ও অমানবিক ।কেউ একটা দেশে জন্মে সেখানে তাঁর কৈশোর কাটিয়ে ফেললে সেটি তাঁর সারাজীবনের স্মৃতি কাতর মাতৃভূমি হয়ে যায়। একটা শিশুর হয়তো স্বদেশ পরিবর্তনে কিছুই যায় আসে না। সে নতুন ভাষা ও কৃষ্টি সংস্কৃতিতে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু একটা কিশোর বা কিশোরীর বেড়ে ওঠার সময়ে মন দৈহিকতায় পরিপার্শ্বের সবকিছুর ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে। লন্ডন, সিডনী, নিউইয়র্ক যাই বলি না কেন, সেখানে বেড়ে ওঠা কাউকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার প্রশ্নই আসে না ! আমার কাছে সেটি বড্ড অমানবিক মনে হয়।

আমার কয়েকজন আত্মীয়পরিজনদেরকে দেখেছি, দেশে ফিরে তাঁরা হয়তো পুনরায় কোন না কোনভাবে আমাদের ধুলাবালিতে অভ্যস্ত হতে পেড়েছেন। মশার কামড়ে তাঁদের তেমন কিছু হচ্ছে না ; কিন্তু প্রবাসে জন্ম নেওয়া বা শৈশবেই চলে যাওয়া শিশু-কিশোরের বাংলাদেশের ধূলায়, লোডশেডিং , ট্রাফিক জ্যামে আর মশার কামড়ে প্রাণান্ত হয়। দেখে মায়া লাগে।

৬। আরেকটি প্রকট বা প্রচ্ছন্ন কারণ আছে। সেটা আমার বেশ কয়েকজন প্রবাসী সতীর্থের সংগে অন্তরঙ্গ আলোচনার উপলব্ধি । আসলে শিক্ষিত বাঙালী মেয়েরা বিয়ের পর নিজের স্বামী সন্তানদেরকেই নিজের পৃথিবী মনে করে। সামাজিকতায় অভ্যস্ত হয়ে, স্বামীর কর্মস্থল যে জেলাতেই হোক, যে দেশেই হোক আপন করে নেয়। তারপরেও প্রবাস জীবনে একাকীত্বের সঙ্গে অবাধ স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ থাকে। ছোট্ট নিউক্লিয়াস পরিবারের স্বামীকে দিনে ঘন্টাখানেক সময়, আর বাচ্চাকে কিছুক্ষণ সময় দিলে বাকী সময় একান্ত নিজের ।
ঠিক উল্টোটা বাংলাদেশে। নিজের স্বামী-সন্তান- সংসারের পাশাপাশি, শ্বশুর- শাশুড়ি, দেবর- ননদ, ভাশুর- ভাবী, স্বামীর মামাতো, চাচাতো খালা-মামা-চাচা-ফুফু ; নাই নাই করেও গুচ্ছের বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে সময় দিতে হয় , ম্যানেজ করে চলতে হয়। পাশাপাশি থাকে পারিবারিক রাজনীতি ও কূটকচাল।

শিক্ষিত বাঙালী প্রবাসী গৃহবধূদের শতভাগ তাই দেশে ফিরে নতুন করে বসবাসে সবচেয়ে বড় অনিচ্ছার কারণ হয়ে পড়েন।