জমিদার, রাজা মহারাজাদের সব কর্মকাণ্ডকে অবলীলায় মেনে নেওয়ার পক্ষে আমি নই। কিন্তু তাঁদের সম্পদের বাহুল্যের মাঝেও সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যাঁরা দান করেছেন, স্কুল কলেজ আর হাসপাতাল করেছেন তাঁদের ব্যাপারে আমার শ্রদ্ধা আছে। একই সঙ্গে বাঙালি মুসলমান সমাজের ধনীদের নিয়ে আছে প্রশ্ন !

নওয়াবি আমলের পরে ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি মুসলমান বড় একটা ভুল করে বসেছিল আধুনিক শিক্ষা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে। সেই অধঃপতনের ধারা তারা আজো বয়ে চলছে। সেই ভুলের খেসারতে হিন্দু সমাজের অনেকে জমিদারির পত্তন শুরু করেন। এঁদের মাঝে আমাদের পূর্ববঙ্গে বহু জমিদারকে পেয়েছি যারা সমাজসেবক ছিলেন। এমন না যে সেই সময়ে সমস্ত মুসলমান একেবারে হত দরিদ্র ছিলেন। বহু সম্পদশালী বাঙালী মুসলমান ছিলেন, কিন্তু মনে করার মতো ফিলান্থ্রপিস্ট ( Philanthropist) ছিলেন হাজী মুহাম্মদ মহসীন। নওয়াব আহসানউল্লাহ্, স্যার সলিমুল্লাহ তো বাংলাভাষী ছিলেন না।

তখন থেকেই গড় সম্পদশালী মুসলমানদের সমাজসেবায় দুর্বলতা আমাদের চোখে পড়ে।

ব্রিটিশ আমলের কথা বাদ দিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নব্যধনী বাঙালী মুসলমানেরা শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য সংখ্যা অনুপাতে মোটেও এগিয়ে আসে নি। সারাদেশ জুড়ে আমরা দেখেছি, বড়লোকেরা বাড়ির পাশে একটা করে কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে মোজাইক করা মসজিদ স্থাপন করে তাদের ও তাদের পরিবারের আখিরাতের সুরাহা করেছেন। চৌধুরী পরিবারের মসজিদে খোন্দকার সাহেবরা নামাজ পড়লে সওয়াব কম হবে, সেই জাত্যভিমানে ২০০ গজ দূরে একই গ্রামে আরেকটি মসজিদ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে আরেকটা মাদ্রাসা। এরা বছরের পর বছর না করেছেন কোন সাধারণ শিক্ষালয়, না করেছেন কোন হাসপাতাল।

আমি আবারো বলছি বাঙালি মুসলমান ধনীরা যা করেছেন তা তাঁদের সামগ্রিক সামর্থ্যের তুলনায় এতো অনুল্লেখ্য যে তা হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়। মাঠ পর্যায়ের ধনীরা আখিরাতের চিন্তায় নিজের ও বাপের নামে মসজিদ আর মায়ের নামে মাদ্রাসা করা ছাড়া তেমন কিছু করেন নাই। এতো এতো মাদ্রাসা দিয়ে দেশের যে তেমন কোন লাভ হয় নি সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই।
পূর্ববঙ্গে রণদাপ্রসাদ সাহা, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী কলেজ, কুমুদিনী হাসপাতাল , কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কী না করেছেন। যদিও তিনি জমিদার ছিলেন না ; ছিলেন সাধারণ থেকে উঠে আসা একজন ব্যবসায়ী। যেদিকে তাকাবেন দেখবেন টাঙ্গাইলের রানী বিন্দুবাসিনী চৌধুরী , বরিশালে ব্রজমোহনের করা বিএম কলেজ ; খুলনায় বাবু ব্রজলাল চ্যাটার্জির বিএল কলেজ। আমার নিজের জেলা কুষ্টিয়াতে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার একাধারে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা থেকে শুরু করে মথুরানাথ প্রেস আর মথুরানাথ স্কুল করে পুরো এলাকার শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এছাড়াও মোহিনী মোহন মিল ও তাদের করা শিক্ষালয়গুলো তো আছেই।

সেই অর্থে নব্যধনী বাঙালি মুসলমানের আর্থিক সামর্থ্য গত কয়েক দশক তুলনারহিত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথায় তাদের সমস্যা ? কেন দেশের যে কোন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে এঁদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে ! সমাজ ও মানুষের সার্বিক কল্যাণে এঁদের অবদান কোথায় ?
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম নামের মহতী প্রতিষ্ঠানের কাজ অনেক আগে থেকেই আমার অসম্ভব ভালো লাগে। নাম পরিচয়হীণ মৃতদেহ যে একটা সন্মানজনক সৎকারের দাবি রাখে এবং সেটা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে, ব্যাপারটা অসাধারণ । আমার ধারণা ছিল এটি ব্রিটিশ পরবর্তী কোন বাঙালি মুসলমানের কেউ করেছেন। পরে দেখলাম এটি তৈরি হয়েছে ১৯০৫ সালে কোলকাতায়।
আচ্ছা, এই লেখার উপরের অংশ লেখা একদিনে। লিখে রেখে দিয়েছিলাম।

আজকে পরের অংশ লিখতে গিয়ে মনে হল, আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে !
ধনী মুসলমান সমাজ তো এগিয়ে এসেছে, আমাদের চারপাশে অনেক হিন্দু স্কুল ও কলেজের পাশাপাশি নব্যধনী মুসলমান সমাজ গত পাঁচ দশকে তাঁদের স্ত্রী-বাবা-মার নামে অনেক স্কুল-কলেজও করেছেন। তারপরেও সমাজের এই দুরবস্থা কেন ? তখন হিসেব করে দেখলাম ; নব্যধনী মুসলমান সমাজ যদি একটা সাধারণ শিক্ষার স্কুল তৈরি করে থাকে, মাদ্রাসা-মসজিদ করেছে দশটা। সুতরাং সমাজে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়েছে বেশি।

মাদ্রাসার মতো একটা অনাধুনিক, অনুৎপাদনশীল, পরিত্যক্ত শিক্ষা সমাজকে এগিয়ে নেবে কী করে ! সেই কুদরতে খুদার সময় থেকে রাষ্ট্র যতোবার মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিকায়ন করতে গেছেন ততোবারই কওমি সম্প্রদায় হা রে রে করে তেড়ে এসেছে। দেশের সবচেয়ে বড় একটা জনগোষ্ঠী আমৃত্যু অনুৎপাদনশীল থেকে জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধি করে গেলে দেশ এগুবে কী দিয়ে !

প্রকাশকালঃ