আমি ছাপোষা চাকরিজীবী। টেক্সটাইল-গার্মেন্টস ট্রেডে আছি দুইযুগ ধরে।

ইদানীং কিছু প্রশ্ন টেবিলে মুখোমুখি বসলেই চলে আসছে। নিজের দুঃখ শেয়ার করতে গিয়ে, অনেকেই এই প্রশ্নগুলো করছেন। নানা প্রশ্ন –ভাই গার্মেন্টসের এ কী অবস্থা ! আপনার মতামত কি , অর্ডার ফ্লো আসবে কবে, আদৌ কি আসবে ? এই সেক্টরের হচ্ছেটা কি ! সরকার কি করছে ? বিজিএমইএ কি করছে? মালিকপক্ষ কি করছে?

এই সেক্টরে বহু রথীমহারথী ছাড়াও শ্রমিক পর্যায়ে সরাসরি জড়িত ৪০ লক্ষ লোক। রপ্তানির ৮১ ভাগ এই গার্মেন্টস দিয়ে আর জিডিপির ২০ ভাগ এখান থেকে। এখন পর্যন্ত আর কোন বিকল্প ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি বা ওঠার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খোঁজ নেওয়া অনুচিত হলেও কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ শেয়ার করতেই পারি। সেটা কারো পছন্দ হবে, কারো হবে না। আমার কাজ আমি করি।
প্রথমত: বাংলাদেশ বিশ্বের গার্মেন্টসের মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ উৎপাদন করে। এর মানে, আমরা মেধাতালিকায় চীনের পরে দ্বিতীয় হলেও সেটা অনেক নাম্বারের ব্যবধানে ! চায়না যদি করে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, আমাদের ৩২ বিলিয়ন করতে হিমসিম। এর মানে, বিশ্ববাজারে আমাদের ইমপ্যাক্ট এমন কিছু নয় যে, আমাদের গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেলে পশ্চিমের লোকজন কাপড়চোপড় ছাড়া অর্ধ-নগ্ন হয়ে চলবে! অন্য দেশগুলোর সক্ষমতা দিয়ে তাঁদের দিব্যি চলে যাবে।

আর, আমাদের বাংলাদেশ যে ধরণের বেসিক গার্মেন্টসগুলো করে ; সেগুলো এখন অবলীলায় পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ভারত, চায়না, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া মায় শ্রীলংকাও করতে পারে। অধুনা আফ্রিকার কিছু দেশও আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা লিখিয়েছে। বছর দশেকের ভিতরে তাদের প্রোডাক্টের গুণগত মান আমাদের কাছাকাছি চলে যাবে বলে আশংকা করছেন সবাই।

প্রথমতঃ  ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি, আমাদের আভ্যন্তরীণ দুটি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থা তাঁদের সোর্সিং এর ব্যাপারে ব্যাক-আপ নিয়েছিল। প্রথমটি ২০১৮ সালের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি। অনেক কাহিনীর পরে সেটা যখন ২০১৮ সালের শেষভাগে কার্যকরী হওয়ার কথা ; তার বহু আগে থেকেই আমাদের সেক্টরের সবাই ক্রেতা-সংস্থাকে ক্রমাগত চাপ দিয়েছেন খুচরা মূল্য বৃদ্ধি করার জন্য। ক্রেতা যে আইটেম ২ ডলারে কিনেছেন ২০১৮ সালে আমরা তাঁদেরকে আওয়াজ দিয়েছি, সেটা বেতন বৃদ্ধির পরে ন্যূনতম ২.৪০ ডলারে কিনতে হবে। আতংকিত ক্রেতা সংস্থা তাঁদের সোর্সিংকে বিভিন্ন দেশে ডিস্ট্রিবিউট করে ব্যাল্যান্স করেছেন। তাঁরা আমাদের উপর ঠিক সেইভাবে ভরসা করতে পারেন নি।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, আমাদের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। এর আগের তথ্য উপাত্ত বলে –প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পরে মাস ছয়েক বা বছর খানেক ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে। এই আশংকা থেকেও তাঁরা কিছু অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নিয়েছেন।
এই দুই ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়াতে দেখা গেল, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অর্ডারের জন্য হাহাকার।
বিশাল বিশাল গার্মেন্টস ! একেকটা ফ্লোর এতো বড় যে এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না ! সেই সব ইন্ডাস্ট্রির ৪০ ভাগ থেকে শুরু করে ৫০ ভাগ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি ফাঁকা থাকা শুরু করল। যে গার্মেন্টস ২ ডলারে করেছেন মালিক, সেটা পারলে তিনি দেড় ডলারে করার জন্য প্রস্তুত। পুরো সেক্টরে একটা অরাজকতা শুরু হল।

এর বাইরে প্রথমেই যে কারণ নিয়ে কথা হচ্ছিল যে , আন্তর্জাতিক মার্কেটে আমাদের তেমন কোন ইমপ্যাক্ট নেই প্রথম থেকেই। না আছে কোন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, না আছে কোন ব্র্যান্ডিং।
‘পুকুর কাটা’ শেখার জন্য আমাদের সরকারী কর্মকর্তারা দল বেঁধে বিদেশ যাচ্ছেন, অথচ এই সেক্টরের অ্যাডভারটাইজমেনটের বা ব্রান্ডিং এর জন কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। আমি কয়েকবার আমেরিকার বিখ্যাত সোর্সিং ফেয়ার বা মেলা ( ম্যাজিক লাস ভেগাস)- এ গেছি কোম্পানির পক্ষ থেকে। আমাদের বিভিন্ন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান ও ট্রেডিং অফিসের আয়োজকদের সঙ্গে ইপিবি , পাট ও টেক্সটাইল মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য আরো নানা শ্রেণির লোক গেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে।

প্রথম মেলায় যাওয়ার আগে। সম্ভবত: ২০১৩ সালে – অংশগ্রহণকারী সবাইকে ডাকা হল, জাতীয় সংসদ ভবনে। মাননীয় সংসদ সদস্য তাঁর নানা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের কোন সমস্যায় তিনি নিজেও আমেরিকাতে থাকবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।

তো, আমদের আমেরিকা ভ্রমণের শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের হুজ্জত পেরিয়ে, গুচ্ছের লটবহর আর গার্মেন্টসের স্যাম্পল নিয়ে আমরা মেলার দুইদিন আগে পৌঁছলাম। জেট ল্যাগ না কাটতেই দেড় দিন ধরে নিজেদের স্টলগুলো সাজালাম সাধ্যমত। একদম প্রথম সারিতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্টল।

৫ দিনের মেলার প্রথম দিন একজন পূর্বপরিচিত সরকারী কর্মকর্তাকে দেখলাম, বিশাল সেই প্যাভিলিয়নে একটা টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। সামনে একটা কাঁচের জারে কিছু চকলেট আর কিছু লিফলেট। হাই , হ্যালো হল। পরেরদিন দেখি তিনি নাই। আমেরিকার স্থানীয় দূতাবাসের একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা বসে আছেন। এদিকে মেলা চলছে, আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নানাভাবে নানা ক্রেতাকে আমাদের বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার জন্য , আমাদের কারখানাগুলো দেখে আসার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছি। দুপুরে খাই কি খাই না। অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে স্বপ্ন দেখি নতুন ক্রেতার অর্ডারের।

দুইদিন পরে দেখি বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির সেই নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাও নাই। ঢুঁ ঢুঁ !
এক চ্যাংড়া বয়সের ছেলে বসে আছে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তিনি, কেন তিনি। যা উত্তর পেলাম, উনি সেই নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার দুঃসম্পর্কের ভাই, আমেরিকা থাকেন, ভাই বলেছে, তাই বসে আছেন ! তো , এই হচ্ছে আমাদের সরকারী সফরের নমুনা।

আগের প্রসঙ্গে আসি। কেন এই অর্ডারের জন্য হাহাকার আমাদের এই সময়ে।

তৃতীয়ত: বিশ্ব মন্দার ধাক্কা অস্বীকার করার কিছু নাই। এটা যে কখন কোন দেশ থেকে শুরু হয়, আর কোথায় যেয়ে শেষ হয়, সেটা আমি অর্থনীতিবিদদের উপরে ছেড়ে দিচ্ছি।
আরেকটা বড় ব্যাপার বিশ্বজুড়ে নীরবে গত দুই দশকে ঘটে গেছে । সেটা হচ্ছে বিনোদনের জগতে ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন ও ভার্চুয়াল সেবা সারা বিশ্বকে গ্রাস করে নিয়েছে। এখন, আমাদের দেশে প্রতি বছর সরকারী হিসাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে ৭ থেকে শুরু করে ১৫ শতাংশ হারে। আর মধ্য-স্বত্বভোগী ও অতি মুনাফাখোরদের লোভে বাড়ে আরো ১০ ভাগ বা আরো বেশি। যে পণ্য আপনি ২০১৮ সালে কিনতে পারবেন ১০০ টাকায়, সেটা ২০২০ সালে এসে হয়ে যায় ১৩০ টাকা বা আরো বেশি।
হ্যাঁ, দফায় দফায় সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন সুবিধা বাড়িয়েছে সরকার বাহাদুর। সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে । বেড়েছে, প্রশাসন ও পুলিশের ক্ষমতা। থানা বেড়েছে, রাজনৈতিক চামচা বেড়েছে, স্যারের সংখ্যা বেড়েছে। শুধু বাড়েনি আমাদের আমজনতার বেতন-ভাতা ও নাগরিক সুবিধা।

ও হ্যাঁ বেড়েছে !

আমাদেরও বেড়েছে ! আমাদের ট্যাক্সের পরিমাণ বেড়েছে, আমাদের যেসব নিত্য-পণ্য ছাড়া চলেনা, সেগুলোর রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি বেড়েছে। ঢাকার মতো একটা ইতরের শহরে ট্রাফিক জ্যাম বেড়েছে।

পশ্চিমা দেশে এতোটা জুলুমবাজি নেই। আমি যে ক্রেতাকে ১০ বছর আগে হাজার চারেক ইউরোর বেতন পেতে দেখেছি, সে আজও ঐ বেতনের আশেপাশে। ১০/১৫ বছর আগে, পশ্চিমাদের বিনোদন ছিল খাওয়া দাওয়া, ঘোরাফেরা আর শপিং।
অধুনা , তাঁদের বাজেটে যোগ হয়েছে, আইফোন, স্যামসাং, আইপ্যাড, নেটফ্লিক্স, আমাজন ইত্যাদি। সুতরাং যে ক্রেতা আগে বছরে ২০টি পোশাক কিনত। সে বাজেট কমিয়ে কিনছে ১০/১২টা বা আরো কম। সে এখন চাইছে, কম দামে টেকসই পোশাক, ইদানীং যার নাম হয়েছে সাসটেইনেবল প্রোডাক্ট, গ্রীন প্রোডাক্ট ইত্যাদি । এই যে বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা কিছুটা হলেও কমেছে, সেটার চাপ পড়েছে বাংলাদেশের মতো দেশের উপরে — যারা খুব লো কস্টে বেসিক গার্মেন্টস বানাতে পারে।

আফসোস ! বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য , নিজেদেরকে কম্পিটিটিভ করার জন্য , সম্মিলিতভাবে আমাদের আরএমজি ( রেডি মেইড গার্মেন্টস) সেক্টরের সঙ্গে জড়িত, মালিক, শ্রমিক, এজেন্ট, বিজিএমইএ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গত তিন দশকে তেমন কিছুই করেনি। চট্টগ্রাম পোর্ট, হাইওয়ে এইসবের কথা বাদই দিলাম ।

এদিকে মালিকদের এক শ্রেণি বুঝে না বুঝে তাঁদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছেন। সেই বাড়তি ক্যাপাসিটি এখন তাঁদের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে। আরেক শ্রেণি ব্যাংকের টাকা হাপিশ করে কানাডা আমেরিকায় কেটে পড়েছে। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১ লক্ষ ২ হাজার কোটি ঋণ অনাদায়ী। আর অনাদায়ী ঋণের মধ্যে শুধু টেক্সটাইল-গার্মেন্টস সেক্টরে অনাদায়ী আছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বোঝেন অবস্থা !

সম্ভবত: ৮৪/৮৫ সালে শোনা। জনৈক ঈশ্বর অবিশ্বাসী নাস্তিক পশ্চিমা ভদ্রলোক ঢাকায় এসেছেন । মাস খানেক থেকে তিনি নাকি বিশ্বাসী হয়ে গেলেন। ‘কেন ভাই? কেন ভাই ?’ তো তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ঢাকায় একমাস কাটানোর সময় তিনি বিভ্রান্তিতে ছিলেন, কীভাবে এই ঢাকার শহর চলছে, মানে কে চালাচ্ছে ! কোন নিয়মনীতি নাই। না আছে সরকার , না আছে অন্য কিছু ! তাই তিনি অবশেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে , অবশ্যই ঈশ্বর আছেন। একমাত্র ঈশ্বরই এই দেশকে চালাচ্ছেন। সুতরাং তিনি নাস্তিকতা ত্যাগ করে ধর্মের পথে চলে এসেছিলেন। তো ৮৫ সাল থেকে ২০২০ , ৩৫ বছরে তেমন কিছুর পরিবর্তন হয় নাই। গতকাল, অফিসের হ্যাপা সামলে, সন্ধ্যা ছয়টায় উত্তরা থেকে মিরপুরের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বিশ্বরোডে এসে দেড় ঘণ্টা গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে থেকে, সোয়া আটটায় বাসায় ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে ঢুকলাম।

এমন একটা দেশে থাকি, যেখানে বেশিরভাগ কাজ হয় আল্লাহর ওয়াস্তে।

আপনার যদি পশ্চিমাদেশে ঈশ্বর অবিশ্বাসী কোন বন্ধুবান্ধব থাকে , তাঁকে ঢাকা শহরে মাস-খানেক থাকতে বলেন। সর্বময় ঈশ্বরের উপরে তাঁর ভরসা না এসে উপায় থাকবে না।

প্রকাশকালঃ ১৫ই জানুয়ারি,২০২০