৬। প্রযুক্তি ও দক্ষতা, এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় :
বাংলাদেশের যে দক্ষ জনশক্তি আছে ও ক্যাপাসিটি আছে, সেটা দিয়ে আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে পৌঁছে যেতে পারি। আমরা পিছিয়ে পড়ছি, আমাদের দক্ষতার কমতিতে। অনেক আগে, ক্লাসে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মাসউদ স্যার বলেছিলেন, চীনে একটি উইভিং লুমে ১০ বছর ধরে একটানা ৪০/৪০ পপলিন কাপড় হচ্ছে। ওই লুমের কর্মী চোখ বুঁজেও সেটা চালাতে পারে। আর বাংলাদেশের একটা লুমে আজ পপলিন তো কাল টুইল, তো পরশু ক্যানভাস কাপড় চলে। বীম চেঞ্জ কর রে, মেশিন স্পেসিফিকেশন চেঞ্জ কর রে, গুচ্ছের হাঙ্গামা ! এফিসিয়েন্সি আসবে কোথা থেকে ? সত্যিকার এফিসিয়েন্সি চায়নার থাকবে না তো কি আমাদের থাকবে?
আবার ২০০৮ সালে আমি একটা বৃটিশ সোর্সিং অফিসে( Mothercare Sourcing UK) বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড ছিলাম। একই সঙ্গে আমাকে ডুয়েল রোল প্লেয়ার হিসাবে গ্লোবাল সোর্সিং ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতে হত। আমাকে নিরপেক্ষভাবে সব দেশের ( মূলত: ভারত, চীন ও বাংলাদেশ) মূল্য-তালিকা তুলনা করে অর্ডার প্লেস করতে হত।

কটন টি-শার্টে আমাদের চেয়ে সাশ্রয়ী মূল্য আর কেউ দিতে পারবে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমাদের সবচেয়ে বেশী দক্ষতার প্রোডাক্টে , মানে কটন টি-শার্টে—দক্ষিণ ভারতের কিছু কারখানা দারুণ কম্পেটিটিভ দাম দিয়ে বাংলাদেশের অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয়দের কে না চেনে ! এঁরা যা জানে না , সেটা বলে বেড়ায়, আর যেটা জানে সেটা কদাপি বলতে চায় না ! আমি জিজ্ঞেস করলাম , তোমাদের এতো ওভারহেড কস্ট, কাটিং মেকিং কস্ট , কিভাবে কটন-টি শার্টের দাম মেলাচ্ছ? যথারীতি কোন সদুত্তর পেলাম না।
আমাকে ওই সময়ে প্রায় প্রতি মাসেই ব্যাঙ্গালোরের Hub Office- এ মিটিং এ যেতে হত।এঁদের সঙ্গে খাতির টাতির করে, কারখানা ঘুরে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সেই সময়ে , কোন একটা গার্মেন্ট শিপমেন্টের আগে মূল কাপড়ের কনজাম্পসন-এর সঙ্গে অতিরিক্ত ওয়েস্টেজ ক্যালকুলেটে করতে হত। সেটা ছিল, ধরেন একটা টি-শার্টের ক্যালকুলেটর কনজাম্পসন ২ কেজি ফিনিশড কাপড়। আমাদের দেশে এর সঙ্গে প্রসেস লস ( নিটিং , ডাইং ফিনিসিং ), কাটিং লস, প্রিন্টিং লস, অলটার ইত্যাদি ইত্যাদি ধরে ১৫ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত অতিরিক্ত কাপড়ের বুকিং দেওয়া হত। তারপরেও দেখা যেত, প্রোডাকশনের মাঝখানে কাপড়ের শর্ট বুকিং আসছে। আবার নিটিং ডাইং, আবার অতিরিক্ত কাপড়। এতো কিছুর পরেও শিপমেন্টের সময়ে ১০০% শিপমেন্ট দিতে পারত না আমাদের কারখানাগুলো। অথচ, ভারতীয় কারখানাগুলো ভার্টিকাল সেটআপের না। এঁরা কাপড় নেয় এক জনের কাছ থেকে, সেলাই করে আরেক জায়গায়। ১০০ কেজি যদি মূল কনজাম্পসন হয় , তবে এঁরা ১০৩/১০৫ কেজি কাপড় বুকিং দেয়। মজার ব্যাপার সেই ১০৩ কেজি ফেব্রিক দিয়ে এঁরা ২% বেশী শিপমেন্ট দেয় ! এখন, আমাদের দেশের যে কোন একটা গার্মেন্টস-এর ন্যায্য দামের সঙ্গে ১৮ থেকে ২০ ভাগের এই যে অপচয়ের , অদক্ষতার মূল্য যুক্ত হচ্ছে—সেটার দাম ক্রেতারা কেন দেবে ?

প্রাত্যহিক কাজের ক্ষেত্রেও তাই। একজন ইউরোপীয় ৫ দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ৪০ ঘণ্টায় যে কাজ করছেন , আমাদের একজন মার্চেন্ডাইজার ৩ সপ্তাহেও তা করতে পারছেন না। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে, যখন দেখি কেউ কেউ গভীর রাত পর্যন্ত মার্চেন্ডাইজিং করছেন। হ্যাঁ, ক্ষেত্র বিশেষে আপনাকে তা করতে হতে পারে, কিন্তু সেটা যখন নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়—আপনার এফিসিয়েন্সি নিয়ে ম্যানেজমেন্ট প্রশ্ন তুলতেই পারেন। হয় আপনার দক্ষতা কম অথবা আপনার সাপোর্টিং হ্যান্ড লাগবে।

কেন এই কথা বলছি, কারণ আমাদের বুড়ো প্রজন্ম কিন্তু গ্রাউন্ড লেভেল মার্চেন্ডাইজিং করে এই খানে উঠে এসেছি। আমাদের সময়ের কারখানার অদক্ষতা কি পর্যায়ের ছিল, সে আর কহতব্য নয় ! অনেকগুলো ঈদের দিনের ভোররাতে ট্রাকে শিপমেন্ট উঠিয়ে আমি বাসায় এসেছি। কোনমতে ঈদের জামাত ধরেছি, তারপরে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ওই ছিল আমাদের ঈদ-বিনোদন। সপ্তাহের ছুটির দিন নামকাওয়াস্তে ছিল শুক্রবার। তাও প্রতি শুক্রবারে ১০/১১টার মধ্যে বাকী কাজ শেষ করার জন্য আমাদের অফিসে যেতে হয়েছে। শুক্রবারে একটু দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাই ছিল আমাদের সবচেয়ে আনন্দের ! সেই তুলনায় এখন এতো বেশী স্মার্ট লোকের সমাগমে কারখানা , ট্রেডিং অফিস সবার দক্ষতা অনেক অনেক বেড়ে গেছে।আপনাদের এই প্রজন্মকে গ্লোবাল কম্পিটিশনে টিকে থাকতে হলে, সময়োপযোগী প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে হবে। একই সঙ্গে নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে, এতে করে আমাদের পুরো ট্রেড উপকৃত হবে।

৭। নিজেকে গড়ে তুলুন নতুন নতুন তথ্য ও ট্রেনিং দিয়ে :
স্মৃতি থেকে লিখছি, সম্ভবত: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট Abraham Lincoln বলেছিলেন “Give me six hours to chop down a tree and I will spend the first four sharpening the axe.” ঠিক এই জায়গাটাই আমি নতুন প্রজন্মকে বলব। নিজের দক্ষতার কুঠারে ধার দিতে থাকেন। অলস সময়ে কোন একটা নতুন ভাষা শিখুন, MBA করা না থাকলে করে ফেলুন। যে কোন ট্রেনিং প্রোগ্রামে সুযোগ পেলে ট্রেনিং নিয়ে ফেলুন।সেদিন এক অনুজ ছোটবোন বলল, নতুন অফিসে যেখানে সে সদ্য যোগ দিয়েছে সেখানে নাকি কাজের প্রেশার আগের তুলনায় অনেক কম। সে তাই ফেসবুক বা অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি তাঁকে বললাম, এই সুযোগ কিছুদিন পরে নাও পেতে পার। কিছুদিন পরে তুমি হয়তো ভয়ংকর ব্যস্ততার মধ্যে পড়ে যেতে পার। তুমি কি MBA করেছ। সে না সূচক উত্তর দিলে , তাঁকে অনুরোধ করলাম, করে ফেলতে।

৮। নির্দিষ্ট সময় পরে নিজেকে এই কর্পোরেট জগতে কোথায় দেখতে চান:
এই প্রশ্নটা ক্লিশে (Cliché ) হয়ে গেছে। প্রতিটা ইন্টারভিউ বোর্ডে সবাই এই প্রশ্নটা করেন। আমার জন্য খুব অস্বস্তিকর ছিল, ২০০৭ সালে আমার বৃটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন আমাকে এই প্রশ্ন করে বসলেন । আমি কেন জানি না সাবলীলভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম যে আমি যেহেতু লোক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি, আমার দায়িত্ব নতুন প্রজন্মকে ডেলিগেট করতে ভালোবাসি ; ৫ বছর পর এখনকার ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বৃহদাকার কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে চাই। ওয়েল , আমি সেটাই করছি এখন।
আরেকটি কথা আমি আমার অনুজদেরকে বলি। দয়া করে আপনি স্বার্থপরের মতো শুধুমাত্র নিজের জন্য কাজ করুন। কোম্পানির কথা , দেশের কথা আপনাকে চিন্তা না করলেও হবে। আপনার দক্ষতা এমন পর্যায়ে নিয়ে যান, যাতে করে আপনার বস আপনার ব্যাপারে খুশী থাকে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ এবং সারা মার্কেট-প্লেস যেন জেনে যায়, হ্যাঁ ওই যে একজন লোক – যাকে বিশ্বাস করা যায় যে কোন কাজ দিয়ে!

আমার CEO—একদিন খুব আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে বলেছিলেন, ‘জাহিদ নিজেকে ব্র্যান্ড হিসাবে তৈরি কর। আমার প্রতিষ্ঠানের বাইরেও লোকে যেন এক নামে তোমাকে চেনে সেই ভাবে কাজ কর। আমি জানি, সবাইকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে সারাজীবন ধরে রাখতে পারব না। কিন্তু আমি ভীষণ গর্ব অনুভব করব, লোকের মুখে শুনতে যে তুমি TEX LINE -এর প্রোডাক্ট !’

৯। সব সমস্যা বসের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে সমাধানের আশা করবেন না ; উনি ঈশ্বর নন:
নতুন প্রজন্মের কম্যুনিকেশন জ্ঞান খুব ভাল। কোন একটা সমস্যা হওয়ার সাথে সাথে তারে ই-মেইল রে, ফোন রে, মিটিং রে করে সারা দুনিয়ার ক্রেতা ও ঊর্ধ্বতনদের সেটা জানিয়ে দেয়। ঠিক আছে। কিন্তু , ওই যে বললাম সবাই সবসময় সমস্যার কথা শুনতে পছন্দ করে না। সমস্যা ছুঁড়ে না দিয়ে, সমস্যা কেন হয়েছে, সম্ভাব্য সমাধান কি কি হতে পারে , সেটা লিখে নিয়ে বসের কাছে হাজির হন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সবচেয়ে সাশ্রয়ী অপশনটা আপনার জন্য বেছে দেবেন, আপনাকে গাইডলাইন দেবেন। এবং একই সঙ্গে আপনার এই কাজে তিনি খুশী হবেন; কেননা আপনি আর সবার মতো সমস্যা তাঁর দিকে ছুঁড়ে দেন নি। বরং সিদ্ধান্তগ্রহণে তাঁকে সাহায্য করেছেন।

১০। দায়িত্বগ্রহণে কখনই পিছপা হবেন নাঃ
আপনি নতুন, আপনার অভিজ্ঞতা নেই, পারবেন নাকি পারবেন না – এইসব ভেবে নতুন দায়িত্ব গ্রহণে পিছপা হবেন না। ম্যানেজমেন্ট প্রো-অ্যাক্টিভ লোক পছন্দ করেন। যোগ্য কিন্তু দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া লোক সামনের দিকে এগোতে পারেন না। সুতরাং অ্যাগ্রেসিভ হয়ে দায়িত্ব নিতে শিখুন। ভুল হবে, ঝামেলা হবে—আপনি নতুন কিছু শিখবেন।

১১। আপনার শক্তিমত্তাকে কাজে লাগান:
আপনার বস হয়তো কারখানার সঙ্গে বা সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে হৈচৈ করে কাজ উদ্ধার করেন। অথচ আপনি একটু ভদ্র গোছের, মুখ খিস্তি করতে পারেন না। ওয়েল, সমস্যা নেই। আপনি যদি ঠাণ্ডা মাথায় ভদ্র-ভাষায় কথা বলে কাজ উদ্ধার করতে পারেন , করেন। বিড়াল কালো না সাদা , তাঁর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিড়ালটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা।

১২। নিজেকে অর্গানাইজ করুন,প্রতিদিনের, সপ্তাহের, মাসের প্রায়োরিটি ঠিক করুন:
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যেটি আমাদের কর্পোরেট জীবনে খুব কাজে লাগে। “If you are not scheduling your day by yourself, some others will do that !” আপনি সারাদিনে কি কি করবেন , সেটা আপনার একটা মাস্টার লিস্ট থাকতে হবে। সেটা দিনশেষে একটা ডাইরিতে লিখে রাখতে পারেন, অথবা অফিসে আসার সময়ে লিখে ফেলতে পারেন। ইদানীং স্মার্ট-ফোনে নানা অ্যাপ্‌স আছে, আপনি সেটার সাহায্য নিতে পারেন। আপনি যদি নিজের দিনকে প্রায়োরিটি অনুযায়ী শিডিউল করতে না পারেন। আপনার সারাদিনের কাজের দায়িত্ব নিয়ে নেবে আপনার বস, অথবা আপনার ক্রেতা বা সাপ্লাইয়াররা। সারাদিন এঁদের নানাবিধ একটার পর একটা কাজে, ফোনে আপনাকে ব্যস্ত রাখবেন, যে সন্ধ্যার সময় গিয়ে আপনার নিজের কাজে মন দিতে হবে। সুতরাং সাধু সাবধান! নিজের দিনের শিডিউলের দায়িত্ব অন্যদেরকে দেবেন না। টেক কন্ট্রোল ।

১৩। আপনার বস, আপনার ক্রেতা বা সরবরাহকারী দিনশেষে কিন্তু একজন রক্তমাংসের মানুষ:
আপনার সারাদিনের কাজ কিন্তু যন্ত্রের সঙ্গে নয়। যাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁরা আমার আপনার মতোই মানুষ। তাঁরাও নিজের নিজের প্রতিষ্ঠানে, নিজের অবস্থানে নিজের মুখ উজ্জ্বল দেখাতে চান; মাস শেষে বেতন আর বছর শেষে ভাল প্রফিট শেয়ার চান। সুতরাং তাঁদেরকে আপনি সাফল্য অর্জনে সাহায্য করলে, তাঁরা আপনাকে সাহায্য করবেন। যে আচরণ আপনি আপনার নিম্নপদস্থদের কাছ থেকে আশা করেন না , সেটা আপনি আপনার আপার হ্যান্ড ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে করবেন না।
ধৈর্য ধরে আমার দুই পর্বের নবীন প্রজন্মের জন্য লেখা কর্পোরেট অব্‌জার্ভেশন পড়ার জন্য আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ।

[প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০১৬]