আমার স্বল্প পরিসরের কর্মজীবনে আমি খুব বেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করিনি। টেক্সটাইলে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছি এদিক সেদিক। অবশেষে কাজ ছেড়েছি বেক্সিমকো(BEXIMCO)- থেকে। পরে যখন গার্মেন্টস-এ আসলাম, মার্চেন্ডাইজিং অভিজ্ঞতার শুরু ওপেক্স(OPEX) গ্রুপে। তারপরে আমার বর্তমান কর্মস্থলে ছিলাম ২০০১ সাল থেকে ২০০৭-এর শেষ পর্যন্ত একটানা সাত বছর। পরের দেড় বছর ছিলাম মাদারকেয়ার সোর্সিং ( Mothercare Sourcing UK) নামের এক বৃটিশ রিটেইলে। পরে ২০০৯ সালের মাঝে আবার পুরনো কর্মস্থলে ফিরে আসা। মূলত: মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্মঅভিজ্ঞতা থেকে এই ধরণের লেখা খানিকটা ধৃষ্টতা হয়ে যায়। অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি!

আমি প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এখনো যাচ্ছি; প্রতিবছর নতুন নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। নবীন প্রজন্মের সবাই দুর্দান্ত মেধাবী, আমাদের বুড়ো প্রজন্মের তুলনায় তাঁরা শতগুণ যোগ্য। আমরা যেখানে কম্পিউটার মানে ‘ ক-অক্ষর গোমাংস’ অবস্থা ছিল। নবীনরা সেই তুলনায় এতো সহজেই সবকিছু বুঝে ফেলে তা দেখে বিস্মিত হতে হয়।

নীচের লেখায় আমি কিছু আমি টেকনিক্যাল জার্গন ( Jargon: special words or expressions used by a profession or group that are difficult for others to understand) ব্যবহার করেছি। ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ আমার ঠিক পছন্দের নয়, কিন্তু কিছু করার নেই। সব কিছুর বঙ্গানুবাদ করা মুশকিল। অধুনা গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং শেখার অনেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, বুটেক্স(Bangladesh University of Textiles) থেকে প্রতিবছর বের হচ্ছেন টেক্সটাইল প্রকৌশলীরা। অন্যান্য বেসরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে আরও অনেকে। এছাড়া প্রতিবছর BGMEA বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রফেশনাল ডিগ্রী নিয়ে এই সেক্টরকে সমৃদ্ধ করছে।
আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, আরেকটু আন্তরিকতা আর প্রচেষ্টা থাকলে আমাদের নবীন প্রজন্ম আমাদের এই গার্মেন্টস শিল্পকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারবেন। কথা কিন্তু সেটাই, এটা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সেটা সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই , অবস্থা, প্রতিষ্ঠান ও প্রেক্ষিত বুঝে আপনাকে নিজের মতো করে তা ব্যবহার করতে হবে।

১। নিজের প্রতিষ্ঠানকে জানুন:
কোথায় কাজ করছেন? কে বা কারা এই কোম্পানি কবে শুরু করেছেন, জেনে রাখুন। আপনি একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অথচ তার আদ্যোপান্ত কিছুই জানেন না, সেটা সমীচীন নয়। কয়টা ডিপার্টমেন্ট আছে, কারা ম্যানেজমেন্ট লেভেলে আছে, বাৎসরিক ব্যবসার পরিমাণ কত। সিনিয়র কাউকে জিজ্ঞেস করুন, মালিক বা মালিক-পক্ষ কিভাবে কিভাবে আজ এতো বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন।নিজের প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস জানলে আপনারই সুবিধা। কারণ আপনি সেল্‌সে থাকেন বা অন্যকোন বিভাগে, নিজের প্রতিষ্ঠানকে ভালোমতো জানলে বাইরের কারো কাছে আপনার অ্যাপ্রোচ অনেক ভালো হবে।

২।আপনার জব রেসপন্সিবিলিটি বা জব ডেসক্রিপশন ( Job Description) কি কি ; ভালোমতো বুঝে নিন:
মূলত: প্রাথমিক অবস্থায় একজন মার্চেন্ডাইজারের এর কাজ থাকে সাপোর্টিং রোলের। আপনার ইমিডিয়েট সুপারভাইজারের কাজগুলো গতিশীল করাই আপনার লক্ষ্য। বসের কাজই আপনার কাজ। বসের সাফল্য আপনার সাফল্য। সবার সামনে আপনার বস-কে সফল দেখানোই আপনার প্রাথমিক লক্ষ্য। তাঁকে সবার সামনে উজ্জ্বল করে দেখানোর জন্য খাটুন। আপনার সুনাম এমনিতেই হবে। আর ইমিডিয়েট বস-এর সুনজরে না থাকলে, আপনার জীবন দুর্বিসহ হয়ে যাবে। উনি প্রতিপদে আপনাকে ত্যক্ত করবেন। আপনাকে ব্যর্থ দেখানোর চেষ্টা করবেন। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন। আমি আমার জীবনে শ্রীলংকান, ভারতীয়, পাকিস্তানী, বৃটিশ, চাইনিজ, আমেরিকান, সিঙ্গাপুরিয়ান, বাংলাদেশী নানা ধরণের বসের সঙ্গে কাজ করেছি। শুধুমাত্র কোরিয়ান কোন বস আমার কপালে জোটেনি। অবশ্য , সেটি নাকি সৌভাগ্যেরই ব্যাপার, তাই সবাই বলে !
প্রায়শ: অভিযোগ শুনতে পাই, ই-মেইল আসার সেকেন্ডের মধ্যে কিছু বস-রা নাকি ফলো আপ শুরু করে দেন। হ্যাঁ, এইরকম খুঁতখুঁতে বসের পাল্লায় আমিও পড়েছিলাম। আমার নিজস্ব একটা টেকনিক দিয়ে পার পেয়ে গেছি সবসময় , সব ধরণের বসের অনর্থক ফলোআপ থেকে। আমি , ইনফরমেশন ওভার-ফিড করতাম।মানে, কোন একটা ইস্যু হয়েছে, আমি প্রতি কয়েকঘন্টা পরে পরে, বস-কে আপডেট দিতাম। সিচুয়েশন কতোখানি উন্নতি বা অবনতির দিকে জানাতাম। তাঁর যতোটুকু তথ্য হলে চলে, তার চেয়ে বেশী দিতাম। ফলে, কিছুদিন পরে তাঁর আমার ব্যাপারে কনফিডেন্স লেভেল বেড়ে যেত। আমাকে অনর্থক ফলোআপ করতেন না।
ও হ্যাঁ, মনে রাখবেন , বস-রা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে ভালোবাসেন। সুতরাং আপডেট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে , তাঁর কাছে সাহায্য চান। অনুরোধ করেন, কাউকে ফোন করে দিতে। এতে করে উনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববেন, ইনভল্ভড ভাববেন। আর ওদিকে আপনার প্রাত্যহিক কাজ ঠিকমতো চলবে।

৩।শেখার ও জানার কোন বিকল্প নেইঃ
নতুন সংস্থায় , নতুন চাকরি হিসাবে আপনার সামনে অবারিত সুযোগ শেখার। প্রশ্ন করতে শিখুন, জানুন এবং প্রশ্ন করুন। নিজের ডিপার্টমেন্টের কয়েকটি প্রোডাক্টে সীমাবদ্ধ না থেকে, কাজের ফাঁকে অন্য বিভাগগুলোতে খোঁজ নিন। আপনাকে কেউ মানা করেনি শিখতে। একটি নির্দিষ্ট গার্মেন্ট তৈরি করতে কয়টি ও কত ধরণের মেশিন দরকার, কি ধরণের প্রোডাক্টিভিটি হওয়া উচিৎ । একজন কোয়ালিটি কন্ট্রোলার সারাদিনে যা যা করছে একদিন তাঁর সাথে কারখানায় যান। তাঁর কাজের প্রতিটি স্টেপ দেখুন, শিখুন। কিভাবে একজন দক্ষ ইন্সপেক্টর ইন্সপেকশন করছেন, দেখুন। নিজেকে একটা ছোট্ট কিউবিক্যালে আবদ্ধ করে রাখলে আখেরে আপনারই ক্ষতি। AQL ; Inspection procedures ; Technical difficulties of Machines ; Needle marks ; Seam Slippage ; Part shading ; Fabric Inspections; Fabric relaxation; Marker; Pattern; Buying seasons of different Customers & Countries ; Report writing; Meeting recap preparation ; WIP ( Work in Progress/Work in Process) ; Critical Path ; Shipping Procedure; Incoterms ; LC ; FOB; C&F; Payment terms ; Testing Machines ; Testing Methods, Testing Parameters & Procedures; Accessories Sourcing ; Accessories Inventories; Garments packing & assortments etc.etc.–জানুন, নিজেকে সমৃদ্ধ করুন।
নির্দিষ্ট ক্রেতার নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট ছাড়াও অসংখ্য প্রোডাক্ট অন্য ডিপার্টমেন্টে চলছে।একেক ক্রেতার জন্য Payment terms আলাদা আলাদা। জিজ্ঞেস করেন, কোথায় হচ্ছে, কত দাম। ফেব্রিক সোর্সিং, অ্যাকসেসরিজ সোর্সিং। কনজাম্পসন কত , কেন এতো দাম , প্রশ্ন করুন , জানুন।

৪। প্রশ্ন করুন, সাময়িক নির্বুদ্ধিতা দীর্ঘকালীন নির্বুদ্ধিতার চেয়ে অনেক ভালো:
পৃথিবীর সকল প্রশ্নের উত্তর সকলের কাছে নেই। কেউ মার্কেটিং সেল্‌সে ভাল, তো কেউ অ্যাডমিন্সট্রেশনে ভাল। কেউ পাবলিক রিলেশনে ভাল। কেউ আবার টেকনিক্যালি ভাল। আপনাদের এখন শেখার সময়। আপনার যদি মেশিন লে আউট জানতে ইচ্ছে করে বা শিখতে ইচ্ছে করে- নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করুন। জ্ঞানী ব্যক্তিটি হয়তো সাময়িক আপনাকে শেখানোর সময় আপনাকে তাচ্ছিল্য করবেন, আপনাকে নির্বোধ ভাববেন। কিন্তু যখনই আপনি তাঁর অর্জিত জ্ঞানটা লাভ করবেন , ব্যাপারটা বুঝে ফেলবেন—আপনি সারাজীবনের জন্য বুদ্ধিমান হয়ে গেলেন। লজ্জা করে, মুখচোরা হয়ে আপনি কি সারাজীবন নির্বোধ থাকতে চান? না চাইলে, প্রশ্ন করুন। জানুন।

৫। মার্কেট ইনফরমেশন / মার্কেট ইন্টেলিজেন্স সম্বন্ধে নিজেকে আপডেট রাখুন:
আমরা বস্ত্র রপ্তানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রথমটি ‘জনাব চীন’ ! কিন্তু আপনি জানেন কি আমাদের বাৎসরিক রপ্তানি মূল্য কত? ২৬/২৭ বিলিয়ন ইউ এস ডলার ! চায়নার কত? প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ইউ এস ডলার !আমারা সেই ক্লাসের রোল নাম্বার টু, যেই ক্লাসের ফার্স্ট বয় বিশাল ব্যবধানের নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হয়েছে।
নতুন রপ্তানির দেশগুলো কারা , জানেন কি ? ইউরোপ ও আমেরিকা ছাড়া , যে কোন দেশে ( অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি ) সবগুলো দেশে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ৫% ইনসেনটিভ দিয়েছিল। সেটা ইদানীং কমিয়ে দিয়েছে। এইগুলো জানলে , কারখানার সঙ্গে মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করাটা আপনার জন্য সহজ হবে।

[ প্রকাশকালঃ ১৮ই  নভেম্বর ২০১৬]