সরকারের কোন হিসাবেই আমার বা আমাদের আস্থা নেই ! শোনা যায় বাংলাদেশের ৭০ ভাগের কাছাকাছি লোক নাকি স্বাক্ষর। এর মধ্যে খুব সামান্য একটা জনগোষ্ঠী টেক্সট বুকের বাইরে কিছু পড়ে অথবা পড়ে না। আবার তার চেয়েও সামান্য একটা অংশ ফিকশন বা নন ফিকশন কিছু পড়ে। আর ক্ষুদ্রতম একটা অংশ পড়ার পাশাপাশি লেখালেখি করে বা চেষ্টা করে।

এখন ধরেন, অন্যদের কথাবার্তা শুনে শুনে –আমি নিজেকে তাদের একজন বলে গণ্য করে ফেললাম ! এবং এটা সেটা পড়াশোনা করে, পুরনো ধ্যানধারণার উপর ভিত্তি করে, রূপান্তর করে নতুনের মতো কিছু একটা দাঁড় করলাম।
ধরেন সেই লেখার যৎসামান্য ভ্যালু আছে অথবা নাই। না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

গুগল বলছে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ১৩ কোটি বই লিখিত হয়েছে। ১০ হাজার বছরের পুরনো বই রক্ষিত আছে মাত্র ৩টি !
৫ হাজার বছরের পুরনো বই আছে, ৫১ টি, হাজার বছরের পুরনো বই ২১৩টি। এখন এই ১৩ কোটি বইয়ের জীবনকাল কয়েকশ বছর পরে কী হতে পারে, আন্দাজ করা যায়।
১০ বছর আগেও প্রতিবছর বই প্রকাশিত হতো সারাবছরে মাত্র ২ লক্ষ !
এখন প্রতিবছর বই প্রকাশিত হচ্ছে ২০ লক্ষ ! জ্ঞানের বিশাল প্রবাহে আমাদের সমকালীন পৃথিবী।

মূল কথায় আসি, আমার সন্তান সে কালো হোক,বোঁচা হোক আমার সন্তান। আমার যেহেতু সৃষ্টি , আমার কাছে তো তা মূল্যবান মনে হতেই পারে। মহাকালের প্রেক্ষিতে যেহেতু আমি, আপনি ও আমাদের সন্তানেরা কেউই থাকবে না; তার মূল্য ও মূল্য-হীনতার প্রশ্ন অবান্তর।
পনেরো আনা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ ছাগলের যতটুকু শিং আছে, তাহাতে তাহার কাজ চলিয়া যায়, কিন্তু হরিণের শিঙের পনেরো আনা অনাবশ্যকতা দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হইয়া থাকি। ময়ূরের লেজ যে কেবল রংচঙে জিতিয়াছে, তাহা নহে— তাহার বাহুল্যগৌরবে শালিক-খঞ্জন-ফিঙার পুচ্ছ লজ্জায় অহরহ অস্থির।……… জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও। কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে— তাহার সকল জলই আমাদের স্নানে এবং পানে এবং আমন-ধানের খেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে। আর-কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে। তাহার যে-জল আমরা খাল কাটিয়া পুকুরে আনি, তাহাতে স্নান করা চলে, কিন্তু তাহা পান করে না; তাহার যে-জল ঘটে করিয়া আনিয়া আমরা জালায় ভরিয়া রাখি, তাহা পান করা চলে, কিন্তু তাহার উপরে আলোছায়ার উৎসব হয় না।………
আমরা যাহাকে ব্যর্থ বলি, প্রকৃতির অধিকাংশই তাই। সূর্যকিরণের বেশির ভাগ শূন্যে বিকীর্ণ হয়, গাছের মুকুল অতি অল্পই ফল পর্যন্ত টিঁকে। কিন্তু সে যাঁহার ধন তিনিই বুঝিবেন। সে-ব্যয় অপব্যয় কি না, বিশ্বকর্মার খাতা না দেখিলে তাহার বিচার করিতে পারি না। আমরাও তেমনি অধিকাংশই পরস্পরকে সঙ্গদান ও গতিদান ছাড়া আর-কোনো কাজে লাগি না; সেজন্য নিজেকে ও অন্যকে কোনো দোষ না দিয়া, ছটফট না করিয়া, প্রফুল্ল হাস্যে ও প্রসন্ন গানে সহজেই অখ্যাত অবসানের মধ্যে যদি শান্তিলাভ করি, তাহা হইলেই সেই উদ্দেশ্যহীনতার মধ্যেই যথার্থভাবে জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারি।……
সকল ঘাস ধান হয় না। পৃথিবীতে ঘাসই প্রায় সমস্ত, ধান অল্পই। কিন্তু ঘাস যেন আপনার স্বাভাবিক নিষ্ফলতা লইয়া বিলাপ না করে— সে যেন স্মরণ করে যে, পৃথিবীর শুষ্ক ধূলিকে সে শ্যামলতার দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে, রৌদ্রতাপকে সে চিরপ্রসন্ন স্নিগ্ধতার দ্বারা কোমল করিয়া লইতেছে। বোধ করি ঘাসজাতির মধ্যে কুশতৃণ গায়ের জোরে ধান্য হইবার চেষ্টা করিয়াছিল— বোধ করি সামান্য ঘাস হইয়া না থাকিবার জন্য, পরের প্রতি একান্ত মনোনিবেশ করিয়া জীবনকে সার্থক করিবার জন্য তাহার মধ্যে অনেক উত্তেজনা জন্মিয়াছিল— তবু সে ধান্য হইল না। কিন্তু সর্বদা পরের প্রতি তাহার তীক্ষ্ম লক্ষ নিবিষ্ট করিবার একাগ্র চেষ্টা কিরূপ, তাহা পরই বুঝিতেছে। মোটের উপর এ-কথা বলা যাইতে পারে যে, এরূপ উগ্র পরপরায়ণতা বিধাতার অভিপ্রেত নহে। ইহা অপেক্ষা সাধারণ তৃণের খ্যাতিহীন, স্নিগ্ধসুন্দর, বিনম্র-কোমল নিষ্ফলতা ভালো।”

শতভাগ অথবা প্রবল সম্ভাবনা আছে, আমার কাছে যে চিন্তাটি নতুন মনে হচ্ছে ; গভীর আবেগে আমি সারা দিনরাত ব্যয় করছি যে চিন্তার পিছনে ; সেটা ঐ ১৩ কোটি বইয়ের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই অসংখ্যবার লিখিত হয়েছে।সুতরাং আমার নব আবিষ্কৃত আবেগ ও ধ্যানধারণা বহু আগেই বাতিলের খাতায় চলে গেছে। যারা সত্যিকার সৃষ্টিশীল যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ষোল আনার মধ্যে এক আনা, প্রয়োজনীয় —তাঁদের কথা বাদ দিয়ে , যারা বাকী পনেরো আনা, এই আমার মতো—তাদের কেউ, যদি সবার মিথ্যা প্ররোচনায় বা অনুপ্রেরণায় কষ্টেসৃষ্টে একটা বই প্রকাশ করেও ফেলে, সেটা আসলে অর্থহীন। বছর দশেক পরে, আমার কন্যাদের স্তূপীকৃত নানা বইয়ের ফাঁকে সেই বইয়ে ধুলো পড়বে। জেলা শহরের অখ্যাত কোন লাইব্রেরিতে শেষের সেলফের উপরের সারিতে মাকড়সার জালের সঙ্গে তার সহাবস্থান হবে। তারপর, দুই দশক পরে এই প্রয়োজনীয় পৃথিবীর কাছে সেটা আবর্জনার বাইরে আর কিছু না !

তাহলে আমি কি লেখালেখি করব না ?

লেখালেখির একটা উদ্দেশ্য তো থাকেই নতুন করে কিছু বোঝার চেষ্টা করা। অথবা অন্যদের চিন্তাগুলো নাড়াচাড়া করে নিজের সময়ের প্রেক্ষিতে নিজের মতো করে কিছু বলা। সমকালে সেটার দাম থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে।

তাহলে আমি কেন লিখব ?

নিজের জীবনের এই সামান্য সময়, ১৩ কোটি বইয়ের মাঝে, আরেকটি বই বাড়িয়ে কেন আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করব ? আমার লেখালেখি যদি আমার প্রজন্মকে নতুন কিছু চিন্তা করাতে নাই পারে, বৃথা কেন কষ্ট করব আমি ?
নাকি শুধুমাত্র নিজের আনন্দের জন্য লিখব, প্রকাশিত হওয়ার আনন্দে লিখব?

এটাতো ঠিক যে, বংশগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জীন আমরা বয়ে নিয়ে চলছি গত ৪৪ কোটি বছর ধরে ! প্রকৃতি চেয়েছে প্রাণের ধারাবাহিকতা রক্ষা হোক। হোক তার সৃষ্টির প্রায় পুরোটাই অর্থহীন, মূল্যহীন। কিন্তু এই প্রবণতা না থাকলে তো সৃষ্টির উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্য রক্ষিত হবে না ! আমার ছোটমামা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং এর সিনিয়র প্রফেসর, বাংলাদেশের জেনেটিক্স জগতের ওস্তাদ মানুষ। আমাকে হাসতে হাসতে একদিন বলছিলেন, ‘বুঝলা ভাগ্নে, প্রাণী যাতে বংশগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, সেজন্য প্রকৃতি তাদের যৌনমিলনে আনন্দ দিয়ে দিয়েছে। এক কাজে দুই কাজ হয় ! প্রকৃতির স্বার্থও রক্ষিত হয় ; আবার প্রাণীরাও আনন্দ চিত্তে সেটা করে !’
লেখালেখির ক্ষেত্রেও কি ব্যাপারটা কি তাই না ? হয়তো কিছু সফল সৃষ্টির অপেক্ষায় , এক আনা প্রয়োজনীয় লেখার জন্য বাকী পনেরো আনাদের নিয়ে প্রকৃতির এই বিশাল আয়োজন। সেই অর্থে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় লেখালেখির দরকার। তা না হলে, কারো কারো শ্রেষ্ঠ লেখাটা রচিত হবে না ; আর সেটা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছুতেও পারবেন না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, দুইটা উদ্দেশ্যেই লেখালেখি করা দরকার। প্রকৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আর নিজের আনন্দের জন্য।