মুক্তবাজার অর্থনীতি , পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র নিয়ে আমার তেমন কোন পড়াশোনা নাই। পুঁজিবাদে মালিকানার অংশীদারিত্ব কীভাবে সম্ভব বা পৃথিবীর শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোথাও সেটা হচ্ছে কীনা আমি জানি না।তবে চাকরির সুবাদে নানা মানসিকতার শিল্পপতি , মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এই দেড়যুগে এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যারা মহল্লার টেইলারিং দোকানের কর্মচারী থেকে শতকোটি টাকার গার্মেন্টস শিল্পের মালিক হয়েছেন। অনেক মালিকের সঙ্গে বয়সের সামঞ্জস্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক ‘ফর্মাল সম্পর্ক’ ছাড়িয়ে ‘বন্ধুত্বের’ কাছাকাছি চলে গেছে।
আবার একই সঙ্গে কাজের স্বার্থে বিভিন্ন শিল্প কারখানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হয়। তাদের সুখ দুঃখের সমব্যাথী হতে হয়। মূলতঃ প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সব সিদ্ধান্ত ও ভালো-মন্দ তাদেরকেই দেখতে হয়। মালিকদের কার্পণ্য ,উন্নাসিকতা, বঞ্চনা ও ক্ষোভের কথা শুনতে হয়। মালিক-কর্মচারীর এই পারষ্পরিক আস্থাহীনতা , বিশ্বাসহীনতার ব্যাপারে আমার বেশকিছু মন্তব্য আছে। এই টানাপড়েন একটি চিরকালীন সত্য, এটা থাকবেই।
তবে, একটা ব্যাপারে আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি আমার অবস্থান থেকে বহু মালিককে অনুরোধ করেছি বা পরামর্শ দিয়েছি।
মূলতঃ নির্দিষ্ট একটা সময়ের পরে যারা প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে মালিকের সঙ্গে থেকেছেন ; শূন্য থেকে প্রাসাদ করে দেওয়ার বিবর্তনে নিজেরাও ক্ষয়িত হয়েছেন– তাঁদের মধ্যে বিশাল এক অনিশ্চয়তা কাজ করা শুরু করে। কারণ, নতুন প্রজন্ম এসে পদাধিকারবলে ক্ষমতায় আরোহণ করেন । সেই আস্থাভাজন কর্মচারীরা তখন নিতান্তই ব্রাত্য হয়ে পড়েন।
‘অতি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ’ কর্মচারী হয় দুর্নীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে , সময় থাকতে আখের গুছিয়ে ফেলে। আর সৎ কর্মচারীরার একটা সময়ের পরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। সবার আগোচরে নিজের আরেকটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান তৈরীতে মন দেন। পরে একসময় বিশ্বাসঘাতকতার তিলক কপালে নিয়ে সরে পড়েন।
যেই শিল্পপতি ২ লাইনের কারখানা থেকে ১৫ বছরে ১৫০ লাইনের কারখানা তৈরি করেছেন। তার রাজপ্রাসাদের ইটে ঐ শ্রমিক-কর্মচারীর ঘাম-রক্ত আছে। কিন্তু আস্থা ও বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে অনেক মালিক তার নির্বোধ শ্যালক , দুঃসম্পর্কের টাউট কাজিন বা ভাই-বেরাদর কে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন, মালিকানার অংশীদার করেন। এবং সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়। অনোপার্জিত অর্থ ও ক্ষমতা মানুষকে কুটিল ও হীণ করে ফেলে।
অথচ মালিক যদি তার ঐ বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজনকে মালিকানার অংশীদারিত্ব দিতেন , তাহলে কর্মচারীদের নিজেদের মালিক হওয়ার প্রবণতা কমে যেত। যে মালিকের ২০০০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি আছে তার জন্য ১০ কোটি টাকার আরেকটা ছোট্ট ইন্ডাস্ট্রি করে বিশ্বস্ত কর্মচারীকে ৫-১০% করে মালিকানা দেওয়া তেমন কিছু না । সেটা হলে, ঐ কর্মচারীরা তো তার আজীবনের কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। আপনার সম্পদ-সৌভাগ্যের মাত্র ০.০০১% পেয়েই সে বাকী জীবন আপনার কর্মচারী-সহকর্মী হয়ে তার সর্বোচ্চ দিতে থাকবে । কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পরীক্ষিত সহকর্মীর চেয়ে আপনার কাছে বখে যাওয়া বিদেশফেরত ভাতিজা বা আপনার ড্রাগ অ্যাডিক্ট শ্যালক বা আপনার নির্বোধ বড়ভাই অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ !
কর্পোরেট জীবনের দীর্ঘ দেড় যুগে আমি কয়েকজন মালিককে কনভিন্স করতে পেরেছি , তারা সুফল পেয়েছেন। কয়েকজন মালিককে নিজে থেকেই যৌথ অংশীদারিত্বের এই প্র্যাকটিস করতে দেখেছি। এতে করে তাদের নিজেদের সম্পদ কমেনি, বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হতে হয় নি। বরং কিছু স্থায়ী সহকর্মী পেয়েছেন যারা জীবন দিয়ে হলেও মালিকের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ও যাচ্ছেন।
প্রকাশকালঃ ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সাম্প্রতিক মন্তব্য