যোগ্যতা ও ক্ষমতা থাকলেই যেমন সেটার যথেচ্ছ ব্যবহার অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। আবার একেবারেই যদি সেটা প্রয়োগ না করা হয়, তবে সমূহ সম্ভাবনা আছে, পাপোশের মতো সবাই আপনাকে মাড়িয়ে যাবে !
প্রাসঙ্গিক একটা শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প। আম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম বহুবছর আগে, স্মৃতি থেকে লিখছি।
অনেক অনেক আগে , এক মাঠে গ্রামের রাখালরা গরু চরাত, মাঠের পাশেই বিশাল বন। তো, সেই বনে একটা বিশাল বড় ও ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ ছিল। সকলেই সেই সাপের ভয়ে সাবধানে থাকত। সাপ আজ এক রাখালকে কামড়ায় তো কাল আরেকজনকে। প্রায়শই গবাদি পশুরা সাপের কামড়ে মারা যায় । সাপের ভয়ে সারা এলাকার রাখালরা ত্রস্ত থাকতো।
একদিন একটি ব্রহ্মচারী সেই মাঠের ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন । রাখালেরা দৌড়ে এসে বললে, ‘ঠাকুর ! ওদিক দিয়ে যাবেন না। ওদিকে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ আছে।’
ব্রহ্মচারী বললেন, ‘তা হোক; আমার তাতে ভয় নাই, আমি মন্ত্র জানি!’
এই কথা বলে ব্রহ্মচারী সেইদিকে চলে গেল। এদিকে সাপটা ফণা তুলে দৌড়ে আসছে, কিন্তু কাছে না আসতে আসতে ব্রহ্মচারী যেই একটি মন্ত্র পড়ল , ওমনি সাপটা তার পায়ের কাছে পড়ে রইল।
ব্রহ্মচারী বলল, ‘ওরে, তুই কেন পরের ক্ষতি করে বেড়াস ? আয় তোকে মন্ত্র দিই!’
সাপ জিজ্ঞেস করলো, ‘মন্ত্রপূত হয়ে কী লাভ?’
ব্রহ্মচারী বোঝালেন, ‘এতে তোর স্বত্বগুণ লাভ হবে ; মন্ত্র জপলে ঈশ্বর ভক্তি হবে, আর হিংসা প্রবৃত্তি থাকবে না।’ এই বলে তিনি সাপকে মন্ত্র দিলেন।
সাপটা মন্ত্র পেয়ে গুরুকে প্রণাম করল, আর জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুর! কি করে সাধনা করব, বলুন?’
গুরু বললেন, ‘এই মন্ত্র জপ কর, আর কারও হিংসা করিস না, কারো অনিষ্ট করিস না !’
তো এইরকম কিছুদিন যায়। রাখালেরা দেখে যে, সাপটা আর কামড়াতে আসে না! ঢিল মারে, তবুও রাগ হয় না। আজ একজন খোঁচা মারে তো আরেক দিন আরেকজন।
চৈত্রের খরদুপুরের একদিন এক রাখাল কাছে গিয়ে ল্যাজ ধরে খুব ঘুরপাক দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিলে মাঝ রাস্তায়। ছোটছোট ছেলে মেয়েরা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে , পিটিয়ে সাপের কোমর দিল ভেঙ্গে। সাপটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগল, আর সে অচেতন হয়ে পড়ে রইল । নড়ে না, চড়ে না। রাখালেরা মনে করলে যে, সাপটা মরে গেছে। এই ভেবে তারা সব চলে গেল।
ঠিক সেই সময়েই , ওই রাস্তা দিয়ে ব্রহ্মচারী ফিরছিলেন ।
সাপের এই দুরবস্থা দেখে ব্রহ্মচারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে তোর এই অবস্থা কে করল ? কিভাবে হল ?’
সাপ উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘আপনি ! আপনি আমাকে এখন এই কথা জিজ্ঞেস করছেন ! আপনার মন্ত্রপূত হওয়ার পর থেকে আমি কাউকে হিংসা করি না, কারো উপরে ক্রোধ নেই, কারো অনিষ্ট করি না, কাউকে কামড়াই না। কিন্তু ঠাকুর, মাঠের রাখালরা তো আর জানেনা যে আমি মন্ত্রপূত হয়েছি; ওদের অনিষ্ট করব না। তবুও তারা আমার এই অবস্থা করেছে !’
ব্রহ্মচারী বলল, ‘ওরে তুই এত বোকা ! নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় জানিস না !
আমি তোকে কামড়াতে বারণ করেছি, ফোঁস করতে তো বারণ করি নাই ! দুষ্ট লোকের অনিষ্ট না করিস, কিন্তু দুষ্টলোকের সাথে বেঁচে থাকতে হলে মাঝে মাঝে ফোঁস করতে হয় !’
[ প্রথম প্রকাশঃ ১০ই অক্টোবর ২০১৫ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য