কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে মিলে যায় বলেই সৈয়দ মুজতবা আলীর এই গল্পটি আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল বছরদশেক আগে। বিশদ লেখার আলস্যে শেয়ার করা হয়নি। মুজতবা ভক্তদের গল্পটি জানা।আমি আমার খুব কাছের কয়েক সহকর্মীকে তাঁদের সিদ্ধান্তহীনতার সময়ে গল্পটি শুনিয়েছিলাম।

তো , মুজতবা আলী শুনেছিলেন এক ইরানী সদাগরের কাছ থেকে খোলা আকাশের নীচে সরাইয়ের চারপাইয়ের উপর শুয়ে শুয়ে। তাঁর ভাষাতেই তুলে দিচ্ছিঃ

দিনমজুর আগা আহমেদ ও তার খান্ডারনী বউ মালিকা খানমের সংসার লোকালয়ের শেষপ্রান্তে বনে। বউ আগা আহমেদকে সারাক্ষণ মিনসে , হাড়হাভাতে, ডেকরা বলে অভিসম্পাত দেয়। আর দিনশেষে শুকনো রুটি। একদিন আগা আহমেদ কী যেন খুঁজতে গিয়ে মালিকা খানমের লুকিয়ে রাখা মুচমুচে রুটি, ভেজা কাবাব , তেলতেলে আচার আবিষ্কার করল। সে রাতে আগা মনের দুঃখে খেল না। খেতে বসে যথারীতি বউয়ের মুখ ঝামটা ! সারারাত ভেবে ভেবে, আগা ঠিক করল, খুন করবে বউকে। তালাক দিয়ে লাভ নেই, একশ বার দেওয়া হয়ে গেছে। আশে পাশে প্রতিবেশী কেউ নেই, যে মনে করিয়ে দেবে – তালাক দেওয়া বউয়ের সঙ্গে সহবাস ব্যাভিচার।

আগা আহমেদ সকালবেলা বনে গিয়ে খুঁড়ল গভীর এক গর্ত, তার উপরে কাঠ, কঞ্চি লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে আসল। বিকেলে বউকে বলল, চল একটু বেড়িয়ে আসি , বউ হাসল দশমিনিট ধরে। ‘ মিনসের পরানে আবার সোহাগ জেগেছে!’ নাছোড়বান্দা আগা, বহু বুঝিয়ে সুঝিয়ে মালিকা খানমকে নিয়ে গেল সেই গর্তের কাছে , তারপর মোক্ষম এক ধাক্কায় নীচে। আরো লতাপাতা দিয়ে ভালো করে গর্তটি ঢেকে দিয়ে বাড়ী ফিরে তিন রকমের মোরব্বা, হালুয়া, আচার , হরিণের মাংস দিয়ে ডিনার। বউ নেই, এই কথা ভাবলেই মনটা খুশীতে ভরে উঠছে তার ! কিন্তু পরদিন সকালে মনের আকাশে একটু হলেও অনুশোচনা জেগে উঠল। হাজার হোক, নবী রাসুলের কসম কেটে বিয়ে করা বউ। ওই অবস্থায় আর পাঁচজন যা করে , আগা তাই করল। ‘ যাক গে ছাই, গিয়ে দেখেই আসিনা, বেটি গর্তের ভিতরে আছে কী রকম।’ গর্তের মুখ সরাতেই পরিত্রাহি চিৎকার , কিন্তু আশ্চর্য ! এতো মালিকা খানমের গলা নয় ! পাতা সরিয়ে দেখে , অ্যাব্বড়ো এক কাল-নাগ , কুলোপনা –চক্কর-গোখরা সাপ । সে তখনো চেচাচ্ছে, ‘ বাঁচাও বাঁচাও , আমি তোমাকে হাজার টাকা দেব, লক্ষ টাকা দেব , আমি গুপ্তধনের সন্ধান জানি, আমি তোমাকে রাজা করে দেব। ’

আগা শুধালো, ‘ তুমি এতো লোকের প্রাণ নাও – নিজের প্রাণ দিতে এতো ভয় কীসের ?’

ঘেন্নার সংগে সাপ বলল , ‘ ধাত্তর তোর প্রাণ ! প্রাণ বাচাঁতে কে কাকে সাধছে। আমাকে বাঁচাও এই দুশমন শয়তানের হাত থেকে। এই রমনীর হাত থেকে। মাগো মা, সমস্ত রাত কি ক্যাট ক্যাটটাই না করেছে, আমি ড্যাকরা, মদ্দা , মিনসে হয়েও অপদার্থ! অবলা নারীকে কেন সাহায্য করছি না গর্ত থেকে বের হতে। ’

আগা আহমেদ বলল, ‘ তা ওকে একটা ছোবল দিয়ে খতম করে দিলে না কেন ?’ চিল-চ্যাচানি ছেড়ে সাপ বলল, ‘ আমি ছোবল মারব ওকে ? ওর গায়ে যা বিষ তা দিয়ে সাত লক্ষ কালনাগিনী তৈরী হতে পারে ! ছোবল মারলে আমি ঢলে পড়তুম না ? ওসব পাগলামি রাখো, আমাকে গর্ত থেকে তোল, অনেক ধনদৌলত দেব, পশুপক্ষীর বাদশা সুলেমানের কসম !’

অবাক ব্যাপার একরাত সাপের সঙ্গে থেকে মালিকা খানমের পরিবর্তন এসেছে, সে মাথা নীচু করে বলল, ‘ ওরা গুপ্তধনের সন্ধান জানে।’

আগা আহমদের টাকার লোভ ছিল মারাত্মক, কিরা কসম কাটিয়ে দুজনকেই গর্ত থেকে তুলল। সাপ বলল, গুপ্তধন আছে, উত্তর মেরুতে—বহু দূরের পথ। তারচেয়ে সহজ পথ বাৎলে দিচ্ছি তোমাকে , শহর কোতয়ালের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরব আমি , কেউ আমাকে ছাড়াতে কাছে আসলেই মেয়েকে ছোবল মারতে যাব। শুধু তুমি আসলেই আমি সুড়সুড় করে সরে পড়ব। তুমি পাবে বিস্তর এনাম, এন্তার ধনদৌলত। কিন্তু খবরদার, ঐ একবার, অতি লোভ করতে যেও না !’

শহরে তুলকালাম কান্ড , কোতয়ালের মেয়েকে তিন দিন ধরে কাল-নাগ গলা জড়িয়ে ফোঁসফোঁস করছে ! লক্ষটাকা পুরষ্কার ঘোষণা হয়েছে, সব ওঝা ফেল মেরছে, বলছে উনি মা মনসার বাপ ! প্রথমে আগাকে কেউ পাত্তা দেয় নাই। ওঝা-বদ্যি হদ্দ হল, ফার্সী পড়ে আগা ! তারপর যা হবার তাই হল, আগা ঘরে ঢোকামাত্রই কাল-নাগ কোথা দিয়ে বের হয়ে গেল, কেউ টেরই পেল না। লক্ষ টাকার সঙ্গে সঙ্গে আগাকে করে দেওয়া হল, ঐ বনের ফরেস্ট অফিসার। আগা সুখী, মালিকা খানম ও দাসী , চাকর-বাকর নিয়ে তম্বি-তম্বা করে ব্যস্ত।

ওমা ! একমাস যেতে না যেতেই , উজীর সাহেবের মেয়ের গলায় একই সাপ ! আগার বিলক্ষন স্মরণ ছিল, একবারের বেশী না যেতে। আগা যতই নারাজী হয়, পাইক পেয়াদা কী ছাড়ে ! সাপ জুলজুল করে তাকিয়ে বললে, ‘ তোমার খাঁই বড্ডো বেড়েছে- না ? তোমাকে না পই পই করে বারন করেছিলুম , একবারের বেশী আসবে না ! তুমি আমার উপকার করেছ, এইবারে মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই শেষবার , আর যদি আসো, মারবো এক ছোবল, তিন সত্যি !’

নওয়াব উপাধি সঙ্গে দশলক্ষ টাকা , পাঁচশ ঘোড়ার সৈন্যদল পেয়েও চিন্তায় চিন্তায় আগার ঘুম নেই, গলা দিয়ে পানি নামে না । কাল-নাগ আবার কখন কী করে বসে। আগা সিদ্ধান্ত নেয়, দেশ ছেড়ে পালাবে।

কী কান্ড, পরদিনই কোতোয়াল স্বয়ং হাজির। ঐ হারামজাদা কাল-নাগ জড়িয়ে ধরেছে শাহাজাদীর গলা। আগা আহমেদ যতোই কোতয়ালের পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদে, লাভ হয় না। কোতয়াল হুকুম করে একে বন্দী করে নিয়ে চল বাদশাহের কাছে। সারাপথ আগা আহমেদ, চোখ বন্ধ করে, নিজের মৃত্যুচিন্তা আর আল্লাহর নাম নিতে থাকে।

স্বয়ং বাদশা হাত ধরে নিয়ে গেলেন রাজকুমারীর ঘরের কাছে। আগা আহমেদ, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কাল-নাগ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘ আবার এসেছিস হারামজাদা, এবার আমার কথার নড়চড় হবে না ! তোর দুই চোখে দুই ছোবল।‘’ আগা বিনীত কন্ঠে বলল, ‘টাকার লোভে আসিনি। সে তোমার বদৌলতে অনেক পেয়েছি। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, তাই তোমার একটা উপকার করতে এলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম , শুনলাম তুমি এখানে। আজ সকালে আমার বিবি মালিকা খানম আমাকে বলেছে, সে আসছে রাজকুমারীকে সালাম জানাতে ! বোধহয় এক্ষুনি এসে পড়বে। তুমি তো ওঁকে চেনো, তাই ভাবলুম তোমাকে খবরটা দিয়ে উপকারটাই না কেন করি , তুমি আমার –— ’ ‘বাপ রে মা রে ’ চিৎকার শোনা গেল । কোনদিক দিয়ে যে , কালনাগ অদৃশ্য হল আগা আহমেদ পর্যন্ত বুঝতে পারল না !

এর পর আগা আহমেদ শান্তিতেই জীবন যাপন করেছিল।

গল্পটি নানা দেশে নানা ছলে, নানা রূপে প্রচলিত আছে । কাহিনী শেষ করে সদাগর মুজতবাকে জিজ্ঞাস করলেন , ‘ গল্পটার “ মরাল” কি, বলো তো ?’

‘ সে তো সোজা, রমণী যে কী রকম খান্ডারনী হতে পারে , তারই উদাহরণ এ দুনিয়ার নানা ঋষি-মুনিতো এই কীর্তনই গেয়ে গেছেন।’ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে সদাগর বললেন, ‘ তা তো বটেই । কিন্তু জানো , ইরানী গল্পে অনেকসময় দুটো করে “মরাল” থাকে। এই যেরকম হাতীর দুজোড়া দাঁত থাকে। একটা দেখাবার , একটা চিবোবার। দেখাবার “মরাল” টা তুমি ঠিকই দেখেছ। অন্য “মরাল”-টা গভীরঃ- খল যদি বাধ্য হয়ে , কিংবা যে কোন কারণেই হোক , তোমার উপকার করে তবে সে উপকার কদাচ গ্রহণ করবে না। কারণ খল তারপরই চেষ্টায় লেগে যাবে , তোমাকে ধনে প্রানে বিনাশ করবার জন্য, যাতে করে তুমি সেই উপকারটি উপভোগ না করতে পারো। অবশ্য তোমার বাড়ীতে যদি মালিকা খানমের মতো বিষ থাকে অন্য কথা ! কিন্তু প্রশ্ন, ক’জনের আছে ও-রকম বউ ?’

 

[ প্রকাশকালঃ ২রা আগস্ট,২০১৬ ]