মানুষের নাম ভুলে গিয়ে আমি নানারকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি এবং এখনো পড়ি। ঢাকা কলেজে একসময় আমাদের গলাগলি ছিল, তুই-তোকারি ছিল; নীলক্ষেতের নীল-পুস্তিকার আদানপ্রদান ছিল। সময়ের টানে আজ আমি স্থুলাকৃতির বিরলকেশ আর সেই বন্ধুও তাঁর শুশ্রমন্ডিত মুখমণ্ডল নিয়ে রীতিমত ব্যাংকের মুরব্বী টাইপ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ! হঠাৎ এক রেস্তোরাতে দেখা ; অনেকক্ষণ ধরে ‘আরে দোস্ত, হ্যাঁরে দোস্ত’ করছি, কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারছি না ! সে হয়তো অন্য কোন ফ্রেন্ড সার্কেলের মাধ্যমে আমার কিছুটা খোঁজ খবর রেখেছে ; আমি খোঁজ খবরতো রাখিইনি নামটাও ভুলে বসে আছি ! একটা উপায় আছে যেটি কার্যকর ; সেই ভদ্রস্থ উপায়টি হচ্ছে আপনার পাশে আপনার স্ত্রী বা কোন সহকর্মী থাকলে দুজনের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিন। তারা নিজেরা পরিচিত হতে গেলে, আপনার ভুলে যাওয়া বন্ধুর নামটি বের হয়ে আসবে।
নাম ভুলে যাওয়ার চেয়েও আমার খারাপ অবস্থা হয় কোন একটা নতুন জায়গার লোকেশন মনে রাখার ক্ষেত্রে! আমার পরিবারের লোকজন আমার এই বিশ্রী দুর্বলতার কথা জানে। আমি নিজে গাড়িচালকের আসনে থাকলে, তাঁদের কেউ কেউ পথপ্রদর্শক হিসাবে রাস্তার ডান-বাম দেখিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিন আগে , মিরপুরের কাজীপাড়ায় দিনের বেলায় আম্মার কাজিন এক খালাম্মার বাড়ী গেলাম। নিজেই চালকের আসনে ছিলাম। ঠিক পরেরদিন সন্ধ্যায় কোন কারণে আম্মা আমাকে ওই একই বাসায় পাঠালেন; আমি দুই ঘণ্টা ধরে সেই বাসা খুঁজে বের করতে না পেরে নাভিশ্বাস ! আবার মেয়ের গানের টিচারের বাসা থেকে সন্ধ্যায় গেছি মেয়েকে আনতে। ঠিক এক সপ্তাহ পরে, বিকালে মেয়েকে পৌঁছে দিতে গেছি ওই একই বাসায় ! আধাঘণ্টা ধরে রাস্তা গুলিয়ে এদিক সেদিক করছি। বড় কন্যা অবশেষে বিরক্তি নিয়ে নিজেই রাস্তা চিনিয়ে দিল।
তো আমাদের একসময় বড় ক্রেতা ছিল Fruit Of the Loom. বাংলাদেশে যে ভদ্রলোক নিয়মিত প্রোডাকশন ফলো আপ করতে আসতেন তাঁর নাম ছিল জর্জ হেগার্টে। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ।উনি আমাদের ফ্লোরের সব মার্চেন্ডাইজার থেকে শুরু করে পিওনদের নাম মনে রাখতেন। দীর্ঘ বিরতিতেও বাংলাদেশে আসলে, ডেস্কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে নাম ধরে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। আমি যদিও ওই ক্রেতার কাজ করতাম না। কিন্তু ভদ্রলোকের ওই অসাধারণ গুণের জন্য এখনো তাঁকে মনে রেখেছি। অফিসে হয়তো কিছু একটা কাগজ, স্ট্যাপলার বা স্যাম্পল লাগবে জর্জের ; যে কোন একজনের নাম ধরে ডাকলে সে সবকাজ ফেলে তাঁর কাজটি করে দিত। আমার ধারণা কারখানাগুলোতেও ওঁর এই অসাধারণ গুণের কারণে ওঁর কাজগুলো আগে ভাগে হয়ে যেত । কে না জানে, স্বল্পপরিচিত কারো নাম ধরে ডেকে কোন সাহায্য চাইলে সেটা পাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকে।
জর্জের দুটো মজার মন্তব্য আমার মনে আছে, মাঝে মাঝেই উনি ব্রিটিশ উচ্চারণে ফ্যাসফেঁসে গলায় নিজের কপালের উপরে তর্জনী রেখে বলতেন, ‘Jahid , take no shits !’ আরেকটি কথাও প্রায়শ: হতাশার সুরে বলতেন ,‘Shit hits the fan!’
প্রথমটি, ‘ Jahid , take no shits !’ বলতেন প্রোডাকশনের কোন ঝামেলার কতটুকু উনি কনসিডার করবেন সেই অর্থে। অন্যের হাগু, কেন তোমাকে নিতে হবে? ‘ Do no Harm, but Take no shit!’ উনি আরেকজনের ভুলের খেসারত আমাদেরকে দিতে মানা করতেন। আবার একই সঙ্গে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এর চেয়ে ভাল পদ্ধতি নেই।
আর কখনো কখনো প্রোডাকশনের অবস্থা ল্যাজেগোবরে হলে, উনি গম্ভীর গলায় বার বার বলতেন ‘Shit hits the fan!’ ‘Shit hits the fan!’ আমি ও সেই সময়ের নবীন মার্চেন্ডাইজাররা ‘Shit hits the fan!’ ব্যাপারটা ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করতাম।কারণ Shit ছাদের fan-কে hit যদি করেই এবং সেই fan যদি চালু অবস্থায় থাকে তাহলে সারা ঘরের যা অবস্থা হবে এবং সেটা কতদিনে পরিষ্কার করে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা যাবে সেটাই একটা দুঃসাধ্য চিন্তা ছিল !
[ প্রকাশকালঃ নভেম্বর ২০১৬ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য