আমি নিজে খুব বেশী একটা সততার কথা বলি না ।‘সততা’ শব্দটি অধিক ব্যবহারে ক্লিশে (Cliché ) হয়ে গেছে; বিব্রত বোধ করি। আমার স্বল্প-জীবনে কেন জানি মনে হয়েছে, ধর্ম, নৈতিকতা, সততা আবার এর বিপরীতে অতিপ্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষিত আর্থিক সাফল্য– একটার সঙ্গে আরেকটি ভীষণ বৈপিরিত্যময় ! একজীবনে এতো আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের কাছে আমরা বড্ডো অসহায় হয়ে পড়ি ! হয়তো সেইজন্য ‘সততা’ শব্দটি ব্যবহারে ভরসা পাই না।

আশির দশকে আমার বেড়ে ওঠা অবাঙ্গালী অধ্যুষিত মিরপুরে বিশাল একটা বাজারের পাশে । বাসার পাশেই বাজার ও জনবসতি সংলগ্ন বিশাল মসজিদ ছিল। বাজারের বড়বড় ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, দোকানদার, কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণীর মানুষ এক মহল্লায় বাস করতাম। অসংখ্য ধার্মিক সৎ লোকের মাঝেও শক্তিশালী পদচারণ ছিল অসৎদের। সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ লোকটিকে দেখতাম মসজিদে সবচেয়ে বড় অংকের চাঁদা দিতে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, একদিন বলছিলেন, ষাটের দশকের নৈতিকতা আর সততার কথা। ধরেন কোন একটা অফিসের কর্মচারী ২০০জন । তো, সেই অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট একজন লোককে দেখিয়ে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, ‘ওই যে দেখছেন , ‘অমুক’ সাহেব, উনার একটু ঝামেলা আছে, মানে হাতের ইয়ে আছে, উপরি ইনকাম আছে। বুঝেনই তো !’আজ কয়েক দশকের নিরবচ্ছিন্ন লুণ্ঠন আর নৈতিক অবক্ষয়ে অবস্থা ঠিক বিপরীত। আজকে ২০০জন লোকের একটা অফিসে এসে কেউ হয়তো ফিসফিস করে বলবেন, ‘ওই যে দেখছেন, ‘অমুক সাহেব’, উনারে দিয়ে আসলে কিছু হবে না, একটু বেকুব কিসিমের আছে, উপরি ইনকাম-টিনকাম কিছুই নাই। ঢাকার শহরে কোনমতে দিনগুজরান করছেন। বেচারা !’ সুন্দরবনের বাঘের মতই সৎ লোকের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বিলুপ্তপ্রায়।

মূল প্রসঙ্গে আসি।

আমার এক মুরব্বী বড়ভাইয়ের ক্যারিয়ারের উন্নতি কাছে থেকে দেখেছি। একেবারে কর্পোরেট আইকন বলতে যা বোঝায়, উনি তাই। দুর্দান্ত স্মার্ট, সারাক্ষণ ফিটফাট, যেমন কথাবার্তা তেমন কাজের দক্ষতা। যে কোন সমস্যা সমাধানে তাঁর উপরে কোম্পানির অগাধ আস্থা। উপরি ইনকামের ব্যাপারে উনি দ্বিধাহীন-চিত্ত ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই গাড়ী বাড়ী নারী সব চেখে দেখেছেন। সেই বড়ভাই কিছুদিন আগে অফিসে এসে আমাকে নসিহত করা শুরু করলেন। সততা নিয়ে অনেক জ্ঞান দিলেন। ধর্মের পথে আসতে বললেন।
ওয়েল, তাঁর অনোপার্জিত অর্থ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা বা মন্তব্য নেই। আমি যেহেতু ভয়ংকর আশাবাদী মানুষ, তাঁর এই আকস্মিক পরিবর্তনে আমি সেই চিরন্তন আশাবাদী মানুষের মত ভাবা শুরু করলাম– উনি হয়তো ঠিকই করেছেন।অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। এটা তো ঠিক, অতিরিক্ত বিত্ত তো আর সৎ পথে অর্জন করা সবসময় সম্ভব হয় না। যেনতেন প্রকারে বিত্ত অর্জনের পরে উনার যে বোধোদয় হয়েছে, উনি যে ধর্মের পথে এসেছেন, অর্জিত অর্থ নানাভাবে দেশেই রেখেছেন ও লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন—সেই বা মন্দ কি ! তাঁর মতো লোকেদের কর্মদক্ষতা নিয়ে আমি সর্বদাই বিস্মিত ও শ্রদ্ধাশীল। আমার মতো হাড় আলসে লোকের পক্ষে তাঁদের ওই সৌভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও কিছু নাই। কিন্তু তাঁদের মুখোমুখি হলেই হিন্দি একটা ওয়ান লাইনার সবসময় মনে পড়ে যায় সেটা হচ্ছে, ‘ শ চুঁহে মারকে, বিল্লি হাজ্ব কো চালি!’ ( এক শ ইঁদুর মেরে অবশেষে বিড়াল হজ্ব করতে চলল ! )

ফ্ল্যাশব্যাক ১:

২০০৫ সালে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে একটা দারুণ বর্ধিষ্ণু বিভাগের প্রধান ; সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার। টেক্সটাইলের ডায়িং ফিনিশিং এর শনৈ শনৈ টাকার জায়গা ছেড়ে কেন আমি মার্চেন্ডাইজিং এ চলে এসেছিলাম সে আরেক গল্প। আমার প্রয়াত আব্বা ব্যাপারটাকে ঠিক সেভাবে পছন্দ করতে পারেন নি। টেক্সটাইলে পড়াশোনা করে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকৌশলী না হয়ে কেন আমি গার্মেন্টস-এর জেনারেল একটা লাইনে গেলাম, সেটা তাঁকে বিরক্ত করেছিল হয়তো।
মার্চেন্ডাইজিং সম্বন্ধে আমি সেই সময় নিজেই তেমন কিছু জানতাম না। ‘গার্মেন্টস এর মার্চেন্ডাইজিং ’—এই তকমাটা আব্বার ঠিক পছন্দ হয়নি। সেই সময়কাল অনুযায়ী বাজারদরে আমি যে বেতন পেতাম তা নিতান্ত মন্দ ছিল না। সংসার খরচের বাইরে কোনরকম সঞ্চয় করতে না পারলেও বছর শেষে আমি আর আমার গিন্নী এদিক সেদিক বেড়াতে যাওয়ার মতো বিলাসিতা করতে পারতাম।

তো সেই সময়, আব্বা এক সন্ধ্যায় আমাকে বেশ উৎসুক হতাশার গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি টেক্সটাইল প্রোডাকশন ছেড়ে , কি জানি বায়িং হাউজের মার্চেন্ডাইজিং না কিসে জানি জয়েন করেছ ! সেদিন তো পজিশনও জানালে, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার। আজকে একটা তোমার বয়সী ছেলে এসেছিল। সে একটা কোরিয়ান বায়িং হাউজে চাকরি করে। পজিশনে মার্চেন্ডাইজার। সে একটা পৌনে দুই কাঠার বাড়ী কিনছে, প্রায় ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে। তুমি কি ধরনের বেতনের চাকরি কর তা তো জানি।’
আব্বার হতাশ কৌতূহল আমাকে একটু বিব্রত করলেও সামলে নিলাম। একটু বেশ কর্কশ ভঙ্গীতেই বললাম, ‘ আমার বেতন কত , আমি সংসারে কত দিই সবই তো আপনি জানেন। আমি যে কোম্পানিতে আছি, তা ঢাকার অন্যতম ভালো কোম্পানির একটা। বেতনও বয়স-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে খারাপ পাই না। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পেরেছি। একটা কোরিয়ান বায়িং হাউজের সামান্য মার্চেন্ডাইজার কিভাবে ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ী কেনে, আর আমি প্রকৌশল ডিগ্রী নিয়ে কি করছি, সেটাই তো আপনার প্রশ্ন ? আব্বা , আমি যে আজকে ৫৫ লাখ টাকার বাড়ী কিনতে অক্ষম , সেটার দায়িত্ব আমি একা কিভাবে নিই? সেই অক্ষমতার দায়িত্ব আপনাকেও নিতে হবে। আপনি আমাদের যে মূল্যবোধ আর সততা দিয়ে মানুষ করেছেন, সেই মূল্যবোধ আর সততাই ৫৫ লাখ টাকার বাড়ী কেনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা !’ আব্বা আমার কর্কশ বলার ভঙ্গী দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলেন। এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন , উনি আমার আর্থিক উন্নতি-অবনতি নিয়ে আর কোনদিন কথা বলেন নাই।একসময়ে আমার খারাপ লেগেছিল, হয়তো অন্যভাবেও তাঁকে বোঝানো যেত। কেন যে ওই কর্কশ উত্তর দিতে গেলাম !

ফ্ল্যাশব্যাক ২:

সপ্তাহ দুয়েক আগে টেক্সটাইলের এক অনুজ এসেছিল ক্যারিয়ারের ব্যাপারে কিছু আলোচনা ও পরামর্শের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে তাঁর কণ্ঠে কিছুটা উষ্মার ছোঁয়া পেলাম। আমি পুরনো ধ্যানধারণা আর মূল্যবোধ নিয়ে কেন চলছি? তাঁর পরিচিত আমার সমসাময়িকরা ঢাকা শহরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।কারো কারো সম্পদের স্রোতের ঢেউ আমেরিকা , কানাডার সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে। তাঁদের তুলনায় আমার যোগ্যতা হয়তো সমান, কাছাকাছি বা কিঞ্চিৎ বেশী। আমারও আরও দূরে যাওয়া উচিৎ ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাঁকে বললাম সে ভারতের সরোদ বাদক ওস্তাদ আমজাদ আলী খান সাহেবকে চেনে কিনা। হ্যাঁ সূচক উত্তর আসল। কথা প্রসঙ্গে জানালাম, ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিচারণে কেউ একজন লিখেছিল। পুরোটা মনে নাই, ঘটনা-সংক্ষেপ অনেকটা এরকম। একদিন এক স্মার্ট তরুণী ইন্টারভিউয়ার ওস্তাদজীর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। নানা কথার ফাঁকে তরুণীটি জিজ্ঞেস করলেন,’ ওস্তাদজি আপনি সবদিকে এগিয়ে আছেন, ভারতের শ্রেষ্ঠ সরোদ-বাদকদের একজন। কিন্তু কিছু ব্যাপারে আপনি কেন যে পুরনো ধ্যান ধারণা নিয়ে আছেন! ওই সব মূল্যবোধ ছেড়ে আপনি কি অন্য সবার মতো আরেকটু আধুনিক হতে পারেন না? তাহলে তো অনেক দূরে যেতে পারতেন !’

ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের বুদ্ধিদীপ্ত ও আধ্যাত্মিক উত্তরটা ভালো লেগেছিল বলে আজ এতদিন পরেও কিছুটা মনে আছে, উনি নাকি বলেছিলেন, ‘যে আমজাদ আলী খানের সঙ্গে তুমি কথা বলছ সে তাঁর অর্জিত মূল্যবোধ আর রুচি সংস্কৃতি নিয়েই গড়ে উঠেছে ; সবকিছু মিলিয়েই আমি । ওই মূল্যবোধ ছাড়া আমার অস্তিত্ব কোথায়? এই মূল্যবোধগুলো আছে বলেই আমি ওস্তাদ আমজাদ আলী খান এবং আরও অনেক লোকের কাছে না গিয়ে তুমি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছ !’
আমার অনুজকে বললাম , আমিতো আর ওস্তাদ-ফোস্তাদ কেউ নই। তবে সামান্য কিছু অনোপার্জিত অর্থের জন্য আমি আমার এতদিনের অর্জন পুরনো মূল্যবোধ ছাড়তে রাজি নই। আর ওই মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে জাহিদের কাছে তুমি পরামর্শ নিতে এসেছ আরও অনেক আর্থিক সফল বড়ভাইদের কাছে না গিয়ে, সেই মূল্যবোধগুলো ছেড়ে দিলে তাঁদের সঙ্গে আমার তফাৎ রইল কি !

আমার সেই অনুজ গম্ভীর মুখে হতাশার সঙ্গে মাথা নাড়ল ! কি বুঝল কে জানে ! মনে মনে নিশ্চয় আমাকে একগুঁয়ে , পুরোন ধ্যানধারণার একজন ভেবেই নিজের পথে পা বাড়াল !