All the chickens of the street are not destined to be the roast on your plate! রাস্তার সকল মুরগী আপনার প্লেটে রোস্ট হয়ে আসবে না।
সে অনেকদিন আগের কথা। পুরনো ঢাকার র্যাঙ্কিন স্ট্রীট থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আব্বা মিরপুরে বসতি গড়েছেন। ৭৮/৭৯ সাল। আম্মার গহনা বিক্রির টাকাতে যে বাড়ী কেনা হয়েছে, আমাদের পুরনো বাড়ীর তুলনায় সেটাকে একটা বস্তি-ই বলা চলে। জহুরুল হকের প্ল্যানের সারিবদ্ধ ছোটছোট বাড়ীর সামনে বৃহদাকার উর্দুভাষী বিহারী ক্যাম্প। সেই সময় সারা গলিতে কয়েকটি বাঙালির বাড়ী। এক বাঙালি ভদ্রলোক আবার নোয়াখালীর ; তার বাড়ির সামনে নেমপ্লেট লেখা আছে , ‘এটা বাঙ্গালীর বাড়ী’ ! কেন লিখে রেখেছেন? অনেক পরে এসে বুঝেছি। মূলত: সদ্য স্বাধীন দেশে শত্রু-সম্পত্তির হালুয়া-রুটির ভাগে বিহারীদের সাথে স্থানীয় বাঙালি নেতা ও প্রভাবশালীদের হুজ্জত লেগেই থাকত। নেতারা নানাভাবে বিহারীদের অসামাজিক কাজে ব্যবহার করত ; আবার প্রয়োজন শেষে তাদের ক্যাম্পে আগুন দিতেও দ্বিধা করত না । আমরা থাকাকালীন ৩ বার আগুন লেগেছিল ক্যাম্পে। একটি দুর্ঘটনা, বাকী দুটি বাঙালি-বিহারী কলহের জের ! সুতরাং আগুন লাগুক আর লুট-পাট হোক , বাঙালি নেতাদের কেউ যেন ভুল করে তার বাড়ীকে বিহারীদের বাড়ী ভেবে না বসে—সেজন্যই ‘জাতীয়তার সাইনবোর্ড’।
আমাদের বাড়ী কেনার পরেও নানা ঝামেলা ছিল। বাড়ীর মূল মালিক পাকিস্তানে চলে গেছেন। রেখে যাওয়া বিহারী কেয়ারটেকারকে দখলমুক্ত করতে আরো গুচ্ছের বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। বাড়িটিকে বসবাসযোগ্য করার জন্য অস্থায়ীভাবে আমাদের গৃহকর্মীর ছোটভাই মকবুলকে পাঠানো হল। বছর পনেরোর কিশোর , ভয়ংকর দুষ্টু। ভাষার ব্যবধান থাকার পরেও, সে কেমন কেমন করে যেন বিহারীদের সঙ্গে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে যেত। ছোট্ট পৌনে দু’কাঠার বাড়িতে নিজের হাঁড়িকুঁড়ি, স্টোভের চুলা পেতে নিজের সংসার মকবুলের ; রাজমিস্ত্রিরা ঘর মেরামত করছে। আমরা মাঝে সাঁঝে আম্মার সাথে, ছোটমামার সাথে আমাদের নতুন বাড়ী দেখতে যাই এবং ‘ তুম্ ওয়াকিল ছাহাবকা লাড়কা আছো?’ টাইপের ভাঙা বাংলার প্রশ্ন শুনে হু হা উত্তর দেই।
তো সেই মকবুল সারাদিন দুষ্টুমির পাশাপাশি একটা মাছ ধরার পলো কোথা থেকে জোগাড় করে ফেলল। সেটার উপরের মুখ বন্ধ করে দড়ি বেঁধে বারান্দায় বসে থাকত। খাবার খেতে চড়ুই পাখী পলোর সীমানার ভিতরে ঢুকলেই অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে সে পলোটা ফেলে দিত। চড়ুইগুলোকে সে আদৌ কীভাবে রান্না করে খেত মনে নেই ! কিন্তু বিহারী শিশুগুলো তাকে রাস্তায় দেখলেই চেঁচিয়ে উঠতো, ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ , ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ মকবুল দিনদুয়েক পরে একটা প্রত্যুত্তর বের করে ফেলল। ওরা সমস্বরে ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ বললেই সে উত্তর দিত, ‘আমি তোর আব্বা !’
কিছুদিন পরে মকবুলের সাহস বেড়ে গেল । আঙিনার খোলা মাটিতে ছোট্ট বাগানে কিছু শাক পাতা বা ফুলগাছ লাগানো হয়েছিল। বিহারীদের মোরগ-মুরগী এসে সেগুলোর বারোটা বাজাতো। বাড়ীর বাইরে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে লাভ নাই, কেননা মুরগীর গায়ে-তো আর নাম লেখা নেই! আর সামনের অগুনিত বিহারী শিশু ও মহিলারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মকবুলের চিৎকার বিমলানন্দে উপভোগ করত। মকবুল সাহস করে সম্ভবত: একটা দু’টো মুরগী ধরে খেয়ে ফেলেছিল। পুরো ঘটনা মনে নেই, আমি নিজেও তখন নিতান্ত বছর ছয়েকের বালক। এরপরে আমরা গেলেই প্রতিবেশীদের মুরগী হেঁটে গেলে সে লোভী চকচকে চোখে খুব উৎসাহ নিয়ে বলত,’মামা দ্যাখেন রোস্ট হাইঁটা যাইতেছে, রোস্ট !’ সে তার কল্পনাশক্তি দিয়ে রাস্তার মুরগীটিকে নিজের প্লেটের রোস্টের চিত্রকল্প তৈরি করে ফেলত।
ঘটনা এর পরে দুর্ঘটনা হয়ে যায়, তার এই দুর্বৃত্ততা কোনভাবে ধরা পড়ে গেলে বিহারীদের সাথে বড় একটা ঝামেলা হয়, আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সামলাতে হয় আমাদের।
বহুদিন পরে মনে পড়ে গেল মকবুলের কথা। অনেক রকমের ব্যবসা, আর হরেকরকমের অংশীদারিত্ব আছে। আপনার যা প্রাপ্য ; আপনার যোগ্যতাবলে যা আসবে তাই আপনার । অর্জন করুন, চৌর্যবৃত্তি বা দুর্বৃত্ততা দিয়ে যে ব্যবসা বা সম্পত্তি আপনি উপভোগ করতে চাচ্ছেন তা আপনাকে বিপদে ফেলবে। মকবুলের মতো রাস্তার সমস্ত মুরগীকেই আপনি আপনার প্লেটের রোস্ট হিসাবে দেখবেন না। He who wants everything every time may lose everything anytime!
আপনার ভাগে চড়ুই থাকলে তাই সই। যে কোন হেঁটে যাওয়া মুরগীকে আপনার খাদ্য ভাবলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে !
[ প্রকাশকালঃ ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য