আমাদের কিংবদন্তী অর্থনীতিবিদদের কাছে ‘চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হও!’ ‘ সামাজিক ব্যবসা’ ইত্যাদি শুনে শুনে আমার মতো কুলি মজুরদেরও মাঝে সাঁঝে জানতে ইচ্ছে করে, এতো বড় একটা প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্ম উদ্যোক্তা হওয়ার পথে কি করছে ! তাঁদের মৌলিক বাধা কি কি ; নবীন উদ্যোক্তাদের কি অবস্থা ? আমাদের নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনা কি ?

সম্ভবত: ২০০৭/৮ এর পর থেকে শিল্প উদ্যোক্তাদের গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অধুনা কয়েকবছর যাবত তা দেওয়া হচ্ছে, এবং সেই গ্যাসের লাইন নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের কি পরিমাণ ‘ স্পিড মানি’ খরচ হচ্ছে ; সেটা শুনলে অনেকের চোখ কপালে উঠবে ! বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, আমাদের জ্বালানী সংকট, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন ট্র্যাজেডি আমাদের বস্ত্রশিল্পকে খোলনলচে বদলে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে অন্যতম রপ্তানীমুখি শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা আসার পরিমাণ গেছে কমে । নতুন টেক্সটাইলে নতুন উদ্যোক্তাদের পদচারণ নেই বললেই চলে । যা হচ্ছে, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ! কারো ৬ লাখ গজ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল, সে এক ধাক্কায় ১২ লাখ গজ করে ফেলছে। কারো ৩০ লাইনের কারখানা ছিল, সে কয়েকবছরে ৬০ লাইন করে ফেলছে। অসম মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অসংখ্য ছোট মাপের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝারি মাপের গার্মেন্টসগুলোর মালিকানা বড় গ্রুপগুলোর কাছে চলে গেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর আরও বৃহদায়তন হচ্ছে।

দেড় যুগ আগে আমার কর্মজীবনের শুরুতে দেখেছি , গার্মেন্টস-এর মালিকদের প্রধান উৎপাদন নির্ভরতা ছিল , কাপড় উৎপাদন করা ও সেলাই করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্যাক-ওয়ার্ড লিংকেজ বা অন্যান্য খুচরা পণ্যের সরবরাহ ছিল পুরোটাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে। বোতাম, টুইল টেপ, লেবেল, সুতা, কার্টন, পলি ব্যাগ, স্ক্রিন প্রিন্ট , এমব্রয়ডারি যাবতীয় সরবরাহ ছিল ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনেক লোকের কর্মসংস্থান হত।এখন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কারখানায় সব ধরণের সার্ভিস ও ব্যাক-ওয়ার্ড লিংকেজ ইউনিট খুলে বসে আছেন।
তাহলে ঐ ক্ষুদ্র- মাঝারি উদ্যোক্তাদের কি অবস্থা ? প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে, পুরনোরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন । এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহাওয়ায় নতুন উদ্যোক্তারা নিজেদের নৌকার পাল না তুলে ‘ আরামদায়ক’ চাকরির বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টর ছেড়ে অন্যদিকে আসি। স্কয়ার বা প্রাণ-আরএফএল এর মতো বড় প্রতিষ্ঠানকে উদাহরণের স্বার্থে উদাহরণ হিসাবে ধরছি। স্কয়ার-এর ফার্মাসিউটিক্যালস দিয়ে ব্যবসা শুরু। পরে টেক্সটাইল, তারপরে ফুড ও বেভারেজ, কসমেটিক্স, টয়লেট্রিজ, হাসপাতাল সব। দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠতায় তাঁদের সকল পণ্য একটা ব্র্যান্ড লেবেল পেয়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্যতা এমন পর্যায়ে গেছে, তাঁদের পণ্য চোখ বুজে ভোক্তারা কিনে থাকে। কিন্তু এমন অনেক পণ্য ছিল, যেগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা করে বেঁচে থাকত। সেগুলোও ধীরে ধীরে স্কয়ার দখল করে নিয়েছে। সামান্য ঝাল মুড়ি বা চীনাবাদামও যদি স্কয়ারের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করে, তাহলে সাধারণ ভোক্তাদের কেউ কি আর চলতি ঝাল মুড়িওয়ালার কাছ থেকে কিনবে ?

ঐদিকে প্রাণ-আরএফএল এর মূল পণ্য সম্ভবত: ছিল, একদিকে তরল পানীয় অন্যদিকে হেভি-লাইট মেশিনারিজ, নলকূপ ইত্যাদি। এখন তাঁরা সাধারণ প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে শুরু করে সামান্য বালতি,বদনা পর্যন্ত উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন। হাস্যকর হলেও সত্য, প্লাস্টিকের বদনা খুবই ছোট মাপের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা করে থাকতেন। যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্লাস্টিকের বদনা, বালতি তৈরি করত তাঁর ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া এখন গত্যন্তর নেই । ব্র্যান্ড ইমেজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অনেক পিছিয়ে আছে। পেপার ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রমরমা বিজ্ঞাপনে সবকিছুই ব্র্যান্ডিং ও বিক্রি করা সম্ভব।

বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রচলিত পণ্য ছাড়াও ছোটখাটো সবরকম পণ্যের বাজার যেভাবে দখল করা শুরু করেছে; দেখে শুনে মনে হচ্ছে , সেই দিন আর বেশি দুরে নেই, কয়েকটি বড় কর্পোরেশন বাংলাদেশের তাবৎ পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকবেন। পুঁজি বাজার ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিজ্ঞাপনে নৈতিকতা পকেটে পুরে ফেলেছেন আমাদের বড় উদ্যোক্তারা।

আবার ফিরে আসি আমাদের টেক্সটাইল ও বস্ত্র খাতে। কেন নতুন উদ্যোক্তাদের দেখা নেই ?কেন এঁরা নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহী হচ্ছেন না ?

প্রথমত: বড় উদ্যোক্তারা ছোটদের ডি-মার্কেটিং করছেন। বড় মাছ, পুকুরের সব ছোটমাছকে খেয়ে ফেলছে।

দ্বিতীয়ত: ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তাদের আগের মতো সহায়তা করছে না। ব্যাংক নিরাপদ বিনিয়োগে বড় ঋণ-খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে আবার নতুন করে ঋণ দিচ্ছে। আর আমাদের অসংখ্য মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না , তাঁদের চাকরি বাজার ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন আদৌ সম্ভব কীনা, হলেও সেটা কীভাবে ! তৃতীয়ত: (এটি আমার ব্যক্তিগত মতও বটে)—ব্রিটিশ কেরানি-নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদের অগুনতি কেরানী তৈরি করছে। শত শত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আমাদের বেশি দরকার – হাজার হাজার কারিগরি শিক্ষা নির্ভর শিক্ষালয়। যেখানে, একজন তরুণকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ,আমাদেরকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলছে। একটা চেয়ার ও টেবিলের বসার সুযোগের জন্য আমাদের সকল সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত ।

বাংলাদেশ সরকারের ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু মাস্টার প্ল্যান হয়তো আছে। আমি জানি না । নানা ধরনের ফান্ড থাকে , এসএমই ( Small Medium Entrepreneur) ঋণ থাকে। সেটা কতখানি সঠিক জায়গায় পৌঁছায় , সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ অমূলক নয়। এবং প্রতিবছরে ওই ফান্ডের যথোপযুক্ত ব্যবহার হয় কিনা , সেটার কোন তথ্য কারো জানা নেই।

কিছুদিন আগে , বিশাল শিল্পকারখানার মালিক এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজেও চাইতেন, ছোট ছোট স্ক্রিন প্রিন্টিং কারখানা , লেবেল, পলি , টুইল টেপ, বাটন , কার্টন ফ্যাক্টরি ফ্যাক্টরি চালু থাক। কিছু লোকজন উদ্যোক্তা হোক। মুশকিল হচ্ছে, তাঁর অভিজ্ঞতা এই ব্যাপারে খুবই তিক্ত ! তিনি হয়তো ভালো মানের সুতা দিয়েছেন তাঁর টুইল টেপ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু , ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অতি লোভে , মাঝপথেই গাড়ীসহ সেই ভালো মানের সুতা বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে, দুনিয়ার উচ্ছিষ্ট খোলা বাজারের সুতা কিনে তাঁর টুইল টেপ বানিয়ে দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় গুণগত মানে তাঁর গার্মেন্টস ফেল করেছে।

একই কথা অন্যসব বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য, এঁরা যে দামে কাজ ছোটদেরকে দেয়। তাঁরা যদি সঠিক উপাদান ব্যবহার করত তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু, কিছু অতিলোভী দ্রুত মুনাফা কামী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কৃতকর্মের দায় নিতে হচ্ছে অন্য সবাইকে। প্রায়শই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করে বড় প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলে দেয়। অনেকবার দেখেছি, সামান্য সুতা, বোতাম, কার্টন, টুইল টেপ, স্ক্রিন প্রিন্ট ফ্যাক্টরির গুণগত মানের সমস্যা অথবা সরবরাহে দেরী হওয়ার গার্মেন্টস মালিককে ডিসকাউন্ট ও এয়ার শিপমেন্টের জরিমানা গুনতে হয়েছে।

দ্রুত বড়লোক হওয়ার ও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পড়ে ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বড় প্রতিষ্ঠানের ভরসা হারিয়েছেন। এখন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কারখানার অভ্যন্তরেই সব ছোট ব্যাক ওয়ার্ড লিংকেজ করে ফেলেছেন। কেননা, তাঁরা তাঁদের মিলিয়ন ডলারের শিপমেন্ট সামান্য কয়েক পয়সার অ্যাকসেসরিজের জন্য হুমকির মুখে ফেলতে চান না।

এই দুষ্টচক্র থেকে কীভাবে বের হওয়া সম্ভব , সেটা নিয়ে কী ধরণের গবেষণা হওয়া উচিৎ সেটা জানার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শেষ করতে হচ্ছে আলোচনা।

প্রকাশকালঃ ১০ই মার্চ, ২০১৭