পাঠক, আমার এই অবজার্ভেশনটা সহজবোধ্য করতে হলে আপনাকে আমেরিকান লেখক ‘ও হেনরি’-এর একটি গল্পে ফিরে যেতে হবে। ‘ও হেনরি’-কে সবাই উচ্চমাধ্যমিকের ‘ The Gift of Magi’ ছোটগল্পের জন্য একনামে চিনে ফেলবেন। নিম্নবিত্ত এক নবদম্পতির( জিম ও ডেলা) খুব সামান্য অর্থ দিয়ে দু’জন দু’জনের জন্য গোপনে ক্রিসমাস গিফট্ কেনে ; অসাধারণ গল্প ছিল সেটা।
যাই হোক, তাঁর আরেকটি গল্প ‘The Cop and the Anthem’ ( ১৯০৪)-এর অনুবাদ পড়েছিলাম সেই ৯০ সালে। কয়েকদিন ধরে কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না—কার লেখা । এক বন্ধু মনে করিয়ে দিল ও হেনরির কথা। বাংলায় অনূদিত হয়েছে ‘সুর ও বেসুর’ নামে।
নিউইয়র্ক শহরের হত-দরিদ্র কর্ম-বিমুখ সোপি প্রতিবছর শীত আসার আগেভাগেই কোন একটা ছোটখাটো অপরাধ করে একটু দূরে একটা দ্বীপের জেলখানায় যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলে। তিনমাসের জন্য খাওয়া দাওয়া আড্ডার নিশ্চয়তা। তীব্র শীতের হাত থেকে বাঁচার এর চেয়ে সম্মানজনক ব্যবস্থা সোপির জানা নেই। মাথা নিচু করে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে তাঁর গায়ে বাঁধে।
গল্পের শুরুতে সে অপরাধ করার জন্য প্রথমে একটা হোটেলে বিনা পয়সায় খেয়ে বিল না দেওয়ার চেষ্টা করে। হোটেল লোক তাঁর জীর্ণ কাপড় দেখে আগেভাগে দূর করে দেয়। পরে সে চেষ্টা করে বড় একটা শো রুম বা দোকানের কাঁচ ভেঙ্গে পুলিশের কাছে ধরা পড়তে। পুলিশ সোপিকে ফেলে অন্য একজন দৌড়ে যাওয়া লোককে সন্দেহ করে তাঁর পিছে ছোটে। মরিয়া হয়ে সোপি তৃতীয় চেষ্টায় একটা সস্তা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সারে, খাওয়া শেষে বলে তাঁর কাছে একটা ফুটো পয়সাও নেই। অনুরোধ করে তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে। পুলিশে ধরিয়ে না দিয়ে , হোটেলের লোক তাঁকে কিছু উত্তমমধ্যম দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। সোপি হতাশায় ভোগে, আশ্চর্য ! অ্যারেস্ট হওয়া এতো কঠিন !
ঠিক পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলাকে সে টার্গেট করে। কাছে যেয়ে কু-প্রস্তাব দেয়। ধরে নেয় এবার নিশ্চিত গ্রেফতার ! কপাল খারাপ সোপির। মেয়েটা আসলে ছিল পতিতা। মেয়েটা উল্টো তার বাহু-লগ্না হয়ে হাঁটা শুরু করে। সোপি একসঙ্গে কিছু দূর গিয়ে দৌড়ে পালায়।
এরপর থিয়েটারের সামনে পুলিশ দেখে সে মাতালের অভিনয় করে, আশেপাশে একটা গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। লোকেরা অভিযোগ করলে পুলিশ এসে বলে, হার্টফোর্ড কলেজের ডিমের ব্যবসায়ীদের কেউ হবে হয়ত, ওদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপরওয়ালাদের নির্দেশ আছে। নিরাশ হয়ে সোপি মাতলামি বন্ধ করে। পুলিশ কি তাঁকে কোনভাবেই গ্রেফতার করতে পারে না !
সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের দামি সিল্কের ছাতা নিয়ে হাঁটা ধরে সে। এইবার তো একটা কিছু হবে।কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা করার পর ভদ্রলোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, সেও নাকি অন্য কোথাও থেকে ছাতাটি খুঁজে পেয়েছিল। হতে পারে, ছাতাটি আসলে সোপির-ই। কিছুদূর গিয়ে ছাতাটি ছুঁড়ে ফেলে সোপি। ‘ধরা পড়তে ইচ্ছে করেছি, আর ব্যাটারা অমনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমি যেন দোষই করতে পারি না।’
হঠাৎ এক নিস্তব্ধ মোড়ে পুরনো গির্জার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। সমবেত কণ্ঠে রবিবারে প্রার্থনা উচ্চারণ করছে সবাই। সেই সঙ্গীত, সেই মূর্ছনা তাঁর হৃদয়কে অভিভূত করে ফেলে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। তাঁর মনে পড়ে যায় শৈশবের মায়ের কথা, বন্ধুদের কথা, ভালোবাসার কথা, রঙিন ভবিষ্যতের কথা। ওই বেদনার স্মৃতি আর অর্গানের করুণ ধ্বনি তাঁর হৃদয়কে ধুয়ে দিয়ে যায় ! তার চোখ খুলে যায় !
এ কী অধঃপতন তার ! এ-ভাবে কুকুরের মতো বেঁচে থাকা , আশা নেই, রঙ নেই। কোন ভরসা নেই, শুধু এক কুটিল অভিলাষ নিয়ে সে বেঁচে আছে কোনমতে।
সে সিদ্ধান্ত নেয় , সে ঘুরে দাঁড়াবে, সে আবার মানুষ হবে। ওই অর্গানের সুর তাকে বদলে দিয়েছে, কালই সে শহরে চলে যাবে। পশমের যে ব্যবসায়ী তাকে ড্রাইভারের চাকরি দিতে চেয়েছিল , তাঁর কাছে গিয়ে কাজটা চাইবে।
[ গল্পের একেবারে শেষে চমক আসে ! ]
হঠাৎ কে যেন সোপির হাত ধরে ফেলল। চকিতে মুখ ফিরিয়েই সে দেখতে পেল: পুলিশ।
‘কী করছ এখানে, বাছাধন?’
‘কিচ্ছু না।’
‘তাহলে হাজতে চল চাঁদ।’
পরের দিন সকালে কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন: ‘তিন মাসের জন্য দ্বীপে কারাদণ্ড দেওয়া হইল।’
এবার আসি কেন এই গল্পটি চিরন্তনত্ব কর্পোরেট জীবনে সঙ্গে যায় ! আমি অসংখ্যবার দেখেছি এই চমক। যেই মুহূর্তে কোন একটি কর্মচারী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন ; কেন জানি না ; সেই তাঁকে চলে যেতে হয় অন্যত্র, অন্য কোথাও। মালিক-কর্মচারী দু’পক্ষ থেকেই ব্যাপারটা দুইভাবে হতে দেখেছি আমি বহুবার। অনেক যোগ্য কর্মচারীকে কে দেখেছি বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানে অবমূল্যায়িত হতে । প্রতিষ্ঠান অন্য অনেক অযোগ্য লোকের মূল্যায়ন করছে, বাকী থেকে যাচ্ছে শুধু আমাদের সেই ‘ট্র্যাজিক’ নায়কটি ! শেষ পর্যন্ত সোপির মত, অনেক ভাঙচুরের পর যখন কর্মচারীটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে—তখন হয়তো সামান্য কোন পদোন্নতি বা তার চেয়েও যৎসামান্য কিছু বেতনবৃদ্ধির হৃদয়হীন অনুপস্থিতিতে সে চলে যায় আরেক প্রতিষ্ঠানে !
আমার নিজের কর্মজীবনেও ঘটে গেছে এই ট্র্যাজেডি ! আমার সবচেয়ে দেদীপ্যমান অবস্থায় আমি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে আরেক কাহিনী । ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে , ট্র্যাজেডিই কারো কারো জীবনের নিয়তি। আমি নিজেও হয়তো আরেকটা ট্র্যাজেডির জন্য অপেক্ষা করছি !
প্রকাশকালঃ ১৯শে নভেম্বর,২০১৬
সাম্প্রতিক মন্তব্য