জুনের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সকলেই করোনা আতঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সচ্ছল জনগণের বাসায় কোয়ারিন্টিন থেকে হাতি-ঘোড়া মারার নানা উপায় থাকলেও দেশের বৃহত্তম অংশ জীবিকার তাগিদেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া। সরকারের নানারকম প্রজ্ঞাপন ও সাবধানবানী কেউ আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। একমাত্র আন্তর্জাতিক সীমানাগুলো ও বিমান চলাচল সীমিত পরিসরে আছে। অফিস, রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন, ট্র্যাফিক জ্যাম সেই আগের মতো। সংক্রমণ বেড়েই চলছে , আইসিইউ-গুলো সব পূর্ণ ; মৃত্যু থেমে নাই।

বাংলাদেশের গড় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদেশগুলোর চেয়ে বেশি সেটা প্রমাণিত হয়েছে। গরমে ভাইরাস বাঁচে না অথবা দুর্বল প্রজাতির ভাইরাস এসেছে এই ধরণের বালখিল্য কথা যুক্তিতে টেকেনি।
আবার সব দুর্যোগে সরকারী তথ্যের উপর অনিবার্য অবিশ্বাসের মতো করোনায় মৃত্যুহার নিয়েও অনেকে আশাহত। ভেবেছিলেন এই ঘনবসতির দেশে গলিতে-গলিতে, রাস্তায়-রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকবে ; দাফন সৎকার করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেটি যে হয়নি, সে আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের জনমানুষের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই এযাত্রা বাঁচিয়ে দিল আমাদের।

গত মে মাসে, প্রবাসী এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল । সে বলছিল, পশ্চিমে একজন কোভিড আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও মৃত্যু যথেষ্ট মানবিক ও গবেষণার ব্যাপার। তাই, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সৎকার করার প্রশ্নই আসে না। মৃত্যুসংখ্যা বেশি হলে সৎকারের আগে মর্গে মৃতদেহ দিনকয়েক পড়ে থাকাটা স্বাভাবিক। আর আমাদের বাংলাদেশে সকালবেলায় কারো মৃত্যু হলে, যোহরের নামাজে তার জানাজা হয় আর দুপুরে মারা গেলে আসর অথবা বড়জোর এশার ওয়াক্তে তার দাফন হয়ে যায়। । মুর্দাকে কতো তাড়াতাড়ি দাফন করা যাবে সেটা নিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সামাজিকতায় মৃতদেহ কীভাবে রাস্তায় বা মহল্লায় পড়ে থাকবে? সেই সুযোগ নেই আমাদের দেশে।

বন্ধুর আরেকটি মত ছিল, আমাদের গ্রাম মফঃস্বলে সকলেই কায়িক পরিশ্রমী। এঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ; চারদেয়ালে বন্দী সচ্ছল জনগণের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা যারা বাসায় পানি ফুটিয়ে খাই, তরিতরকারি ধুয়ে খাই, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকি, গাড়িতে চড়ি , তাদের ইমিউনিটি প্রান্তিক জনগণের চেয়ে কম। উদাহরণ দিয়ে বলল যে , আমাদের বয়সী বন্ধুদের কয়েকজন যদি পথচলতি রাস্তার ড্রেনের পাশের ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে চটপটি খায়, তবে কী হতে পারে। দুয়েকজন যে অতিঅবশ্যই পেটের পীড়ায় ভুগবে সে দিব্যি করে বলা যায়। কিন্তু এই ঢাকারই বস্তিবাসী যারা বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন, গাদাগাদি জীবনযাপনে অভ্যস্ত একই খাদ্যাভ্যাসে তাদের কি কিছু হবে ? মনে হয়, হবে না। তো সেই বন্ধু রসিকতা করে বলল, তাৎক্ষণিক পরীক্ষায় এদের অধিকাংশের দেহে দুই রকমের ডায়রিয়া আর তিন রকমের কলেরার ব্যাকটেরিয়া এমনিতেই পাওয়া যাবে। এন্তার সিজনাল ভাইরাস তো থাকবেই। কোভিড-১৯ ভাইরাস এদের কাবু করতে পারবে না। ওঁর মতের সঙ্গে এই আগস্টে এসে একমত পোষণ করতেই হচ্ছে। অবশ্যই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে মারা গেছেন, সেটা প্রত্যন্ত জেলা শহর থেকে ঢাকার মিডিয়াতে এসে পৌঁছায়নি ; তবে সংখ্যায় সেটা আশাতীত রকমের কম।

ছোটমামার সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন। ফোনে সেদিন বলছিলেন , করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলেও মনে হচ্ছে আতঙ্কটা আর নেই রে ! অবাধ চলাফেরা, মেলামেশা করা পাবলিকের ভাবখানা হচ্ছে, ও আচ্ছা, মৃত্যুই তো !
আমার মনে হয়, করোনার ব্যাপারটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে তীব্র আতঙ্ক থাকে। কিছুদিন পরে সবাই বোমা, মৃত্যু, হাসপাতালে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যুদ্ধের ভিতরেই একসময় সোমত্ত ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি হয়, সন্তানাদি হয়। যুদ্ধকালীন মানবিক সঙ্কটকে স্বাভাবিক মনে করা শুরু করে। দিনশেষে বাসায় রেডিও টিভিতে হতাহতের কথা শুনে একটু আতঙ্কিত হয়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, আবার বেমালুম ভুলে যায়।

করোনায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে, তবে বিমান ও পর্যটন খাতের অবস্থা একেবারে কেরোসিন মনে হচ্ছিল। ইদানীং গত রোজার ঈদেও অনেকে এদিক সেদিক সামাজিক দূরত্ব রেখে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি।

বন্দিজীবনে তিক্ত হয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোকে একটু খোলা বাতাসে নিয়ে গেলাম গত পরশু। ঢাকার পাশেই একটা রিসোর্টে। ঢাকার সীমানা অতিক্রম করার পরে, মনে হোল না যে দেশে করোনা আতঙ্ক আছে। অর্ধেক লোকের মুখেই মাস্ক নেই। গতমাসে অনেককে সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঘুরতে যেতে দেখেছি আর বাড়ি এসে কোভিড আক্রান্ত হয়ে কোঁকাতেও দেখেছি। যাদের নির্বোধ ব্যাকুলতা নিয়ে হাসি তামাশা করেছি, নিজেরাই সেই কাজ করে এলাম। তাই, সেটা লুকানোর কিছু দেখি না।

প্রকাশকালঃ ৯ই আগস্ট,২০২০