১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন আতঙ্ক আর ভয়াবহতার কথা আম্মার মুখে শুনেছি কয়েকবার। কীভাবে তাঁদের দিন যেয়ে সন্ধ্যা নামত আর সারাটা দিন যেতো পাকিস্তানী আর্মির নৃশংসতা আর ধারেকাছে ওদের পৌঁছে যাওয়ার নানা গুজবে । সন্ধ্যা হলেই ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। কুপি ও হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় দ্রুত রাতের খাওয়া খেয়ে নিয়ে আরো নিঃশব্দে ট্রানজিস্টার খুলে বিবিসি আর স্বাধীন বাংলা বেতারের নব ঘোরানো। সারাক্ষণ একটা বুকভার করা চাপা আতঙ্ক। নিজের দীর্ঘশ্বাসে নিজেই চমকে ওঠা ! আবার ভোরের অপেক্ষা। একেকটা দিন প্রিয়জনদের নিয়ে বেঁচে থাকা মানেই সৃষ্টিকর্তার কাছে অসীম কৃতজ্ঞতা !

স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের ঐ দুঃসহতার ধারেকাছের কোন অভিজ্ঞতা নেই । তবে শ্বাসরুদ্ধকর, দীর্ঘমেয়াদী আতঙ্ক ও অসহায়ত্বের একটা অভিজ্ঞতা আছে আমাদের ! সেটা স্বৈরাচার লেজেহোমো এরশাদের শাসনামলের শেষের কয়েকটা বছর। সবরকমের আন্দোলন ব্যর্থ ও তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল ঐ হারামজাদা বিশ্ববেহায়ার কাছে । বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, দিনের পর দিন কী এক দুঃসহ দম আটকে আসা অসহায়ত্ব নিয়ে এরশাদের ভণ্ডামি সহ্য করেছে বাংলাদেশে। অত্যাচারের মূল ধাক্কাটা গেছে ঢাকাবাসী ও ছাত্রসমাজের উপর দিয়ে। আমাদের সদ্য কৈশোর পার হওয়া মনে ৯০ এর গণআন্দোলনের নানা বীভৎস স্মৃতিচিহ্ন এখনো দাগ কেটে আছে !

আর আছে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা । ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরে শেষবারের বন্যার অভিজ্ঞতা ছিল ৯৮ তে। তখন, প্রতিবছর ছোট বা বড়মাপের বন্যা অবশ্যম্ভাবী ছিল। সরকারের যৎসামান্য প্রস্তুতি থাকত কী থাকত না। মূলত: প্রতিটা বন্যাপ্রবণ এলাকার জনগণের নিজস্ব প্রস্তুতি থাকত। তবে রাজনৈতিক সামাজিক নেতৃত্বকে দেখা যেত এই সুযোগে নৌকায় করে চিড়ে-মুড়ি, ওরস্যালাইন, খিচুড়ি নিয়ে মফস্বলের বন্যাদুর্গত এলাকায় ছুটে বেড়াতে। বন্যা শুরু হলে ট্রেন লাইনের উঁচু পাড় আর স্কুল-ঘরগুলোতে উদ্বাস্তু বন্যার্তদের মানবেতর জীবন শুরু হতো।

বন্যা শুরু হলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে তা যে চলে যেত ; পানি একবার টান দেওয়া শুরু করলে সপ্তাহখানেকের ব্যাপার –সেটা সবাই জানত। যতো দ্রুত চলে যায় সে জন্য সবার প্রার্থনা ছিল, অপেক্ষা ছিল, সাহায্য ছিল, ত্রাণ ছিল। আর ছিল, বন্যা চলে যাওয়ার পর কত দ্রুত পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে সেটার । বছর দশেক পরপর বন্যা তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিত বাংলাদেশকে। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস এতোটা দীর্ঘমেয়াদী আতঙ্ক তৈরি করতে পারত না। ঝড়ের মতো এসে ঝড়ের মতো চলে যেত। শহরের লোকে সেটা টেরও পেত না।
কোভিড-১৯ বা করোনা নিয়ে সে রকমটি ভাবতে ইচ্ছে করছে। বন্যা ঠেকানোর মতো কিছু আমাদের ছিল না, পুরোটাই প্রকৃতি ও ভারতের ফারাক্কা বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার উপর নির্ভর করত। করোনা এসেছে, চলেও যাবে ! আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করে টিকে থাকা জাতি ; কোন না কোনভাবে টিকে যাব। কিন্তু করোনার পরে পুনর্বাসন কীভাবে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত জাতি কীভাবে উঠে দাঁড়াবে সেটাও ভেবে দেখার দরকার।

প্রকাশকালঃ ২৪শে মার্চ,২০২০