অবসরজীবন নিয়ে চিন্তা।
কর্মক্লান্তিতে একসময় শুধু বিশ্রামের কথা ও সদর্থে রিটায়ারমেন্টের কথা চিন্তা করতাম।
মনে হতো সব সুখ বোধহয় নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রামে। কাজে ব্যস্ত থাকা মানেই কামলা শ্রেণির লোক। পৃথিবীতে যে যতো সম্পদশালী, তাঁর ততো বেশি অবসর আর বিশ্রাম।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটা বয়সে এসে বুঝেছি, রিটায়ারমেন্টের দিকে ধাবিত হওয়া মানে নিজেকে সমাজের কাছে মূল্যহীন করার চিন্তা করা। বরং নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলেই মানুষের বেঁচে থাকার স্পৃহা থাকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের ভিতরে থেকে নিজেকে মূল্যবান মনে করতে চাওয়াটাই শ্রেয়।

মধ্যবিত্তের রিটায়ারমেন্ট মানে– পুরোপুরি অপাঙতেয় মূল্যহীন জীবন। ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। আমাদের সমাজে অবসর নেওয়া সুস্থ ব্যক্তিটির সামনে দুইটা রাস্তা খোলা থাকে– কবরস্থান আর মসজিদ। এঁরা তসবিহ্ নিয়া মসজিদে যাওয়া আসা করে আর এবং সারাক্ষণ সাড়ে তিনহাত অন্ধকার কবরের কথা চিন্তা করে। সারাক্ষণ মৃত্যু-চিন্তায় মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়। কাজ নেই , আলো নেই, বাতাস নেই, হাসি নেই, দুরারোগ্য সার্বক্ষণিক মৃত্যুর দুশ্চিন্তায় কে না বুড়িয়ে যায় !

গতানুগতিক বাঙালীরা চল্লিশ পেরুতে না পেরুতেই অবসর জীবনের চিন্তা শুরু করে। আমাদের দুই প্রজন্ম আগে ত্রিশ পেরুলেই এই চিন্তা আসতো আর চল্লিশ পেরুলে হজ্জ্ব সেরে তসবীহ্ গুনত। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কিছুটা সুবিধা পাচ্ছি আমরা।

এর চেয়ে বরং একটা স্মৃতি রোমন্থন করি।
প্রায় একযুগ আগে, চীনা বংশোদ্ভূত এক ক্রেতা, যিনি কিনা দ্বিতীয় প্রজন্মের আমেরিকান, তার সাথে কথা হচ্ছিল। বয়স প্রায় ৬৫ হবে। সে কোম্পানির এমডি, সর্বেসর্বা।

টাকা পয়সা পরিশোধ নিয়ে ঢিলেমির জন্য আমি এক পর্যায়ে বললাম, ‘কাহিনী কি ? এইটা ঝুলিয়ে রাখার মানে কি ? তুমি মালিক, তুমি বললেই তো হয়ে যায় ! ’

সে বলল, ‘আমার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে আবার কে? তার কথাতো আগে বলো নাই।’
‘উনি আমার বাবা।’
‘বয়স কতো ?’
‘৮৯ বছর !’
‘এই বয়সে সে অফিস করে ! ’
‘না, সেই অর্থে অফিস করে না ! তিনি প্রতিদিন নিয়মিত সকাল আটটায় অফিসে আসেন ঘড়ি ধরে। আমি তাঁর ব্যবসার উত্তরসূরি ; আমার অফিসের ফিন্যান্সটা এখনো উনিই দেখেন। মাঝে মাঝে দুপুরের পরেও থাকেন , নইলে বাড়ী যেয়ে বা এলাকার চ্যারিটি কিছু সংস্থা আছে সেখানে সময় কাটান !’

‘উরি বাপস্ , বলো কি তুমি !’

আমার বিস্ময় প্রকাশে সে বলল, ‘ তোমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে আমাদের এটা একটা বড়ো মানসিক পার্থক্য। তোমরা তীব্রভাবে পরকালে বিশ্বাসী। আমরা নই। আমরা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের ভিতরে থেকে নিজেকে মূল্যবান মনে করতে চাই।’

চল্লিশ পেরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। বড়ো কোন অসুস্থতায় না পড়লে, যতদিন পারি কাজের ভিতর থাকব। সেই কাজ অর্থকরী হোক বা সমাজকল্যাণমূলক হোক। মরার আগে মরতে চাই না। অপাঙতেয় মূল্যহীন জীবন চাই না ।