ধর্ম ও নৈতিকতার পারস্পরিক সম্পর্ক হাজার বছর আগে ছিল। আধুনিক পুঁজিবাদের এই যুগে ধর্ম ও নৈতিকতার পারস্পরিক কোন সম্পর্ক নেই। ধার্মিক লোক মানেই সৎ, নৈতিক, বিবেকবান, উপকারি, মহৎ লোক নয়। সংশয়ী, অজ্ঞেয়বাদী, প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী লোকেরাও অসম্ভব নৈতিক ও বিবেকবান হতে পারেন।

আমার এই উপলব্ধি পদে পদে দেখে ও ঠেকে শেখা। স্বল্প-জীবনে উপলব্ধি, নৈতিক লোক ধার্মিক হলেও হতে পারেন ; অন্য ধর্মের হতে পারেন অথবা ধর্মহীনও হতে পারে। অনেকটা ইশকুলের ক্লাস সেভেন-এইটের বিজ্ঞানশিক্ষার মতো, ‘সকল ক্ষারই ক্ষারক কিন্তু সকল ক্ষারক ক্ষার নহে।

মিরপুরে আমার শৈশবের বেড়ে ওঠা বিশাল একটা বাজারের পাশে।
বাড়ির পাশেই বৃহদায়তন মসজিদ, মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসা। বাজারের সব ব্যবসায়ীরা ওই মসজিদে আসতেন। ভেজাল থেকে শুরু করে, কালোবাজারি, মজুতদারি, সিন্ডিকেট ও বহুবিধ দুই নাম্বারি ধান্ধার কথা ছোটবেলা থেকেই জানতাম। জীবনের নানা চড়াই উৎরাইতে আমি অনৈতিক লোকেদের ধর্মের লেবাসে ও মুখোশে দেবদূতের চেহারায় ঘুরতে দেখেছি। মুশকিল হচ্ছে, প্রায় প্রতিটি ধর্মেই পার্থিব যে কোন অন্যায় করে প্রায়শ্চিত্ত ও মুচলেকা দিয়ে সর্বময় পরম-করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারটা আছে। এজন্যেই বেশিরভাগ ধার্মিকরা বছরের পর বছর অর্থলিপ্সু দুর্নীতি চালিয়ে যান । যেমন আমাদের ধর্মে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, ভণ্ডামি, দুর্নীতি, নষ্টামি যাই করেন না কেন, হজ্ব করে দুধে ধোয়া শিশুর মতো অপাপবিদ্ধ হওয়া যায়। এই অদ্ভুত চক্র দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ধার্মিক ব্যক্তিকে পুরোপুরি নৈতিক হতে দেয় না। একেবারে শেষ বয়সে এসে সে নানা অক্ষমতায় নিতান্ত বাধ্য হয়ে ক্ষান্তি দেয় দুর্নীতির।

বন্ধু-মহলে যখনই ধর্ম ও নৈতিকতা নিয়ে কথা আলোচনা তর্ক, কুতর্ক চলে ; তখনই বাঙালি মুসলমানের শিখা আন্দোলনের কথা মনে আসে। যা কীনা ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হিসাবে পরিচিত। শিখা আন্দোলনের মটো ছিল: “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট – মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”

শিখা আন্দোলনের অন্যতম মোতাহের হোসেন চৌধুরী এবং তাঁর সুবিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সংস্কৃতি-কথা’ খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সীমিত-সংখ্যক পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে তাঁর প্রবন্ধের চুম্বকাংশ আবারো:

সংস্কৃতি-কথা। মোতাহের হোসেন চৌধুরী।।

ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা—সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।

ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরের আদেশে নয়, ভেতরের সূক্ষ্ণ চেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের ওপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ণ চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্ণ চেতনার অপর নাম আত্মা।

সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়—উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাহ্কে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ’র উক্তি: Beware of the man whose God is in the skies—আল্লাহ্ যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে-কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাহ্কে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন-যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটি প্রথমশ্রেণির সিট রিজার্ভ করার আগ্রহে—অন্য কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ।

অন্যদিকে কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে , অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না—এই তাদের ভেতরে দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই হোক কালচার নেই। কালচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ। …………..

অনেকে সংস্কারমুক্তিকেই সংস্কৃতি মনে করে, উভয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখতে পায় না। কিন্তু তা সত্য নয়। সংস্কারমুক্তি সংস্কৃতির একটি শর্ত মাত্র। তা-ও অনিবার্য শর্ত নয়। অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। সংস্কারমুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি অসম্ভব। মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির চেয়ে কুসংস্কারও ভালো। শিশ্নোদর-পরায়ণতার মতো মন্দ সংস্কার আর কী হতে পারে? অর্থগৃধ্নতাও তাই—কিন্তু এসব মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তিরই ফল। তাই শুধু সংস্কারমুক্তির উপর আস্থা স্থাপন করে থাকা যায় না। আরও কিছু দরকার। কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ—এ-সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না। সূক্ষ্ণ জীবনের প্রতি টান সংস্কৃতির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির টান সে দিকে নয়, তা স্থূল জীবনেরই ভক্ত।

সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দর ভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা ; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে গিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা ; কাব্যপাঠের মারফতে, ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা ; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে , মহতের জীবনদানে বাঁচা ; গল্পকাহিনীর মারফতে, নরনারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা ; ভ্রমণকাহিনীর মারফতে, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা ; ইতিহাসের মারফতে মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা ; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকার বাঁচা । বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে , গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

(সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধের খণ্ডাংশ)