শর্টকাট ক্যান কাট ইউ শর্ট (Shortcut can cut you short)।
সবকিছুতে শর্টকাট ভালো নয়। কেননা, শর্টকাট পদ্ধতি আকস্মিক কর্তন করে আপনাকে শর্টও করে দিতে পারে। আমার যে শান্তিপ্রিয় টাইপের চরিত্র ; বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, শৈশব থেকে এটা এমনিতেই আমি মেনে চলতাম। অন্যকে কনুই দিয়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রাসী মনোভাব আমার কখনই ছিল না। কোনকিছু পেতে হলে লাইনে দাঁড়াতাম, ভাগ্যে থাকলে আমার টার্ন আসতে আসতে হয়তো পেতাম, হয়তো পেতাম না। ব্যাপারটা পরিবার ও অন্তর্মুখিতা থেকেই এসেছে। তারুণ্যে পৌঁছে অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। নিজের অধিকার চাইবার অভ্যাস হয়েছে।

ইতিহাসে আছে, আলেকজান্ডার দি গ্রেটের প্রয়াণের পরে টলেমি ( Ptolemy ) মিশরের শাসনকর্তা হন। সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত গণিতবিদ ইউক্লিড(Euclid)-এর গবেষণা নিয়ে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ ছিল ; কিন্তু তিনি সহজে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সম্রাট হয়েও ইউক্লিড-কে তিনি অনুরোধ করলেন সহজ কোন উপায়ে তাঁর গণিতকে আয়ত্ত করা যায় কীনা। ইউক্লিড উত্তর দিয়েছিলেন, জ্যামিতি শেখার জন্যে কোন রাজকীয় পথ নেই। (“Sire, there is no royal road to geometry.” )

সেই আদিম যুগ থেকেই অনিশ্চয়তা মানুষকে লোভী করেছে। ব্যক্তি মানুষের আদিম জৈবিক, শারীরবৃত্তীয় লোভের সঙ্গে ভোগবাদ আরও নানা উপকরণকে অপরিহার্য করে তাঁকে অধিকতর লোভী করে তুলেছে। তোমার মতো, অন্য আরেকজনের আছে, তোমার নেই কেন? আরেকজনের হচ্ছে, তোমার কেন হবে না? অন্যে পারলে তুমি কেন পারবে না ? কেন? কেন? কেন?

সত্যি কথা বলতে কী, এই সামগ্রিক পুঁজিবাদী লোভই কিন্তু সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। দিন-কয়েক আগে, বড়কন্যা আমাকে কোন একটা আলস্য নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিল। আমি বললাম, দেখ পৃথিবীতে বড়বড় আবিষ্কারের পিছনে অলস লোকেদের কৃতিত্ব। পরিশ্রম করেই যদি জীবন চালানো মেনে নিতো মানুষ, তাহলে এতো গাড়ি, ট্রেন, উড়োজাহাজ আর প্রযুক্তি তৈরি হত না। কীভাবে আরও আরামে, আরও অনায়াসে, আরও সহজে কাজ করা যায় সেটা আবিষ্কারের উদ্ভাবনী স্পৃহা আলস্য থেকেই এসেছে।

পুঁজিবাদী পৃথিবীতে কতো দ্রুত কোন কিছু অর্জন করা যায়, সেটার একটা কুৎসিত, দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা আছে। আমাদের তৃতীয় বিশ্বে নিয়তিবাদী লোকেরা, কিছু না পেলে ভাবে কপালে নেই, সর্বময় ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেয় না, ইত্যাদি। কিন্তু পশ্চিমাদেশের লোকেরা তো আর এতোটা নিয়তিবাদী নয়। সে জানে কীভাবে কোনকিছু অর্জন করতে হয়, এ জন্যেই সেসব দেশে মোটিভেশনের বই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। কীভাবে কম পরিশ্রম করে মিলিয়নার হওয়া যায়, সেটা নিয়েই বোধহয় এঁদের লক্ষাধিক বই আছে! মোটিভেশন বক্তা এবং তাঁদের অনূদিত বই বাংলাদেশেও দারুণ জনপ্রিয়

প্রযুক্তির যুগে এই দ্রুত শর্টকাটে বিখ্যাত হওয়ার লোভ প্রকটতম। সারাক্ষণ অপরিণত মস্তিষ্কের লোকের টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটা , ইউটিউব আপনাকে বিশ্বাস করাবে, যে আপনিও একটু ইচ্ছে করলেই ওঁদের মতো হতে পারবেন ; যা চান তাই অর্জন করতে পারবেন ; যেখানে খুশী যেতে পারবেন। কোটিপতি ও সফল চকচকে লোকটি হওয়া কোন ব্যাপারই না, শুধু একটু কষ্ট করে আপনাকে ‘ইচ্ছে’ করতে হবে, ‘মোটিভেটেড’ হতে হবে। এই চক্করে পড়ে মানুষ শর্টকাট খোঁজে। এই নিয়ম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের কৈশোরে বা তারুণ্যে বন্ধুদের মধ্যে যারা দ্রুত, অস্বাভাবিক বা বাঁকা-পথে কোন কিছু অর্জন করার চেষ্টা করতো, শুদ্ধ বাংলায় তাঁদের ‘চালিয়াত’ বলতাম। আরেকটু অশুদ্ধ বাংলায় ‘পাকনাদোচা’ বলতাম।

তবে নানা অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে , দ্রুত সফল কিংবা আর্থিক লাভবান হওয়ার আশায় অপ্রচলিত, অনৈতিক শর্টকাট পদ্ধতি অবলম্বন না করাই ভালো। অতিরিক্ত লোভ ও স্বল্প সময়ে সাফল্যের আকাঙ্ক্ষায় অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছে। সবসময় শর্টকাট সাফল্য বয়ে আনেনা ; বরং তা মর্মান্তিক ব্যর্থতা কারণ হতে পারে, সেটা মাথায় রাখা ভালো। স্বাভাবিক উপায়ে ও গতিতে আপনি দ্রুত সম্পদ ও সম্পত্তির অধিকারী না হতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে সুখী হবেন।