ছেলেটির বয়স যখন সাত-
চাঁদা দিতে না পারায় চোখের সামনে তাঁর বাবাকে
সপাটে চড় কষিয়েছিল পাড়ার এক নেতা ;
কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি।
দু’বছর—
সরকারী জমিতে শনি-মন্দির তুলতে বাধা দেবার জন্য
‘প্রকাশ্য দিবালোকে’ তার দাদাকে ফেলে পিটিয়েছিল
যেসব ছেলেরা,
একদা তারা অন্য দলের হলেও, এখন ওই নেতারই
অনুগামী।
ছেলেটি এসব দেখেছিল।
সে দেখেছিল—
১)একটা লোকও বাধা দিতে আসেনি। ২) অজ্ঞান
দাদার মুখে জলের ঝাপটা দিতেও পারেনি কোন বন্ধু,
কারণ ‘পাঞ্জা’ কেটে নেওয়ার ভয় ছিল।৩) পাড়ার ডাক্তার
প্রাথমিক চিকিৎসাও করতে আসেনি। ৪) থানা কোন
এফ-আই-আর নেয় নি।৫)পুরপিতা তার কোঁচকানো মুখের
বাবাকে বলেছিলেন, ‘দোষ তো আপনার ছেলেরই , সে কেন
লাগতে যায়…!’
দেখতে-দেখতেই ছেলেটার ষোলো বছর বয়স হল।
তার গাল এখন কচি দুর্বাঘাসের গালচে, হাড় হয়ে উঠছে
চওড়া
নাইন-টেনের মেয়েরা এখন তার দিকে আড়চোখে তাকায়,
কিন্তু তারা জানে না,
ঘাসের ঐ গালিচার নীচে তার চোয়াল হয়ে উঠেছে কঠিন,
চোখের কোনায় জমেছে রক্ত,যা সাদা চোখে দেখা যায় না।
গল্পে বা সিনেমায় এসব ছেলেরাই এখন রুখে দাঁড়ায়,
শোধ নেয় বাপ-দাদার অপমানের,
হাতে তুলে নেয় বিচার-
অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহ্রুখ খান
আমাদের এমনটাই দেখিয়ে আসছেন।
কিন্তু, শিল্প ও জীবনের মধ্যে, কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে
অহর্নিশ যে লুকোচুরি চলে,
তাতে মাঝে-মাঝেই আমাদের শিল্প ও কল্পনা যে
মারাত্মক হোঁচট খায়, তাতে আর সন্দেহ কী !
ষোলো বছরের ঐ ছেলে , একদিন সামান্য বিবাদের জন্য,
আর তিন বন্ধুর সঙ্গে নিজের বাবার পেটেই ঢুকিয়ে দিল
চাকু।
খুব স্বাভাবিক,
কারণ, ছোট থেকেই সে দেখেছে,
এই লোকটাকে মারা যায়—কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।
বাধা দিতে এসেছিল তার দাদা—
ফালাফালা হয়ে গেল সেও।
কেননা, তাকেও তো মারা যায়,
মারলে কোন শাস্তি হয় না,
পুলিশ এফ-আই-আর-নেয় না,
পুরপিতা চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘দোষ তো ওরই…।’
তারপর, অস্ত্রগুলো ধুয়েমুছে পরিপাটি করে টেবিলে সাজিয়ে
স্বাভাবিক মুখে বেরিয়ে পড়ল চারজন।
ভোরের আগেই তিনজন সীমান্ত পেরিয়ে গেল,
দূরে কোথাও বৃষ্টি হওয়ায় তারা ঠান্ডা বাতাসও পেয়েছিল।
আর, চতুর্থজন—আমাদের নায়ক—আশ্রয় নিল
সেই নেতার কাছে,
একদা যিনি চড় মেরে তার বাবাকে সহবৎ শিখিয়েছিলেন।
কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই—ছেলেটি জামিন পেল।
প্রত্যক্ষদর্শী নেই—বেকসুর খালাস পেল।
প্রত্যক্ষদর্শী নেই—পিতৃসম্পত্তি পেতেও অসুবিধা হল না।
পাড়ার মোড়েই এখন তার আড্ডা,
চোখের রক্ত আরো গাঢ় হয়েছে, সাদা চোখে
যা বোঝা যায় না।
নাইন-টেনের মেয়েরা এখন তাকে দেখলেই
ঘরে ঢুকে পড়ে,
আবার দমচাপা সেই ভয়ের মধ্যে আকর্ষণও যে কিছু নেই
জোর দিয়ে বলা যায় না কিছু।
এরকম কেন হয় !
হে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাগণ,
এরকম কেন হয়—
এটাই তো আপনাদের প্রশ্ন?
তবে শুনুন,
এই মহতী বাস্তবতার অনুপম ভিত্তিটি
অমর্ত্য উদাসীনতায়, কুটোটুকুও না নেড়ে
আপনারাই এতদিন ধরে তৈরী করেছেন।
এখন আপনাদের ভেড়ুয়া বললে…
মাইরি বলছি… ভেড়ুয়াদেরই খিস্তি করা হয়।
‘দেশ’ বর্ষ ৬৩ সংখ্যা ১৯। ২৯ আষাঢ় ১৪০৩। ১৩ জুলাই ১৯৯৬
সাম্প্রতিক মন্তব্য