এই ডিসেম্বরে কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রবাসী বন্ধুদের কল্যাণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে আমাদের ৯০ ব্যাচের কয়েকজনের পরপর দু’টি ঘরোয়া আড্ডা হয়ে গেছে। স্যারের সঙ্গে সময় কাটানোর মহার্ঘ স্মৃতি কিছুটা ধরে রাখতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে আমার দু’টো সুবিধা। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ; আর বহুদিন পরে হলেও ফিরে এসে এই স্মৃতিগুলো নেড়ে দেখার সুযোগ।

শিক্ষক-ছাত্রের ঘরোয়া অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো এতো বেশী অনাড়াম্বরময় ছিল যে, সেখানে বাঙালির আলস্য থেকে শুরু করে বার্ধক্য, মৃত্যু-বেদনা নিয়েও কথা হয়েছে। শিক্ষক-ছাত্রের ঘরোয়া আড্ডা অন্য কারো বিনোদনের কারণ হলে সেটা বাড়তি পাওনা।

আড্ডার শুরুতে আমাদের প্রবাসী সতীর্থ মনে করিয়ে দিল, ‘জাহিদের তো নিয়মিত আসার কথা ছিল। ও কি এসেছিল ?’ স্যার সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে অনেক উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ ও তো প্রায় দশ বারো বার এসেছে!’ স্যারের বলার ভঙ্গীতে সবাই টের পেয়ে গেল, আমি গতবছর দেখা করে যাওয়ার পরে এই প্রথম আবার এলাম। আমাকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা চলল।

স্যার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র নিয়ে নতুন স্বপ্নের কথা শোনালেন। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া জমিতে কেরানীগঞ্জের ওখানে প্রায় ২ বিঘার উপরে আরেকটি বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র হচ্ছে। নীচে কমিউনিটি সেন্টার থাকবে। যেটার উপার্জন থেকে, কিছুটা হলেও কেন্দ্র চালানোর সাশ্রয় হবে। আমাদের সময়ে প্রায় ২৬ বছর আগে কেন্দ্রের পাঠক-সংখ্যা ছিল হাজারে। এখন শুধুমাত্র স্কুল পর্যায়েই ২৫ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী কেন্দ্রের বই পরে। ২০১৯ সালে স্যারের স্বপ্ন ৪০ লক্ষ ছেলেমেয়েকে কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে আনার।

কেন্দ্রের কেন কোন প্রচারণা নেই , এই প্রশ্নের উত্তরে স্যারের সোজা জবাব, প্রচারণা তাঁর পছন্দের নয়। আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে বই পড়ার মাধ্যমে একটা ছেলে বা মেয়ের সে মানসজগৎ গড়ে ওঠে ; বাজারই প্রচারণায় অসংখ্য অনাকাঙ্ক্ষিত বাহুল্যকে সেই টোটকা দেওয়া অর্থহীন। পরিশীলিত মন একদিনে হয় না; সময় লাগে। কেন্দ্রের ভিতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কয়েকটা মিলনায়তন করা হয়েছে, কোনটি বড় সেমিনারের জন্য, কোনটি পাঠচক্রের। স্যার আমাদের সবাইকে দেখালেন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতা আন্দোলন চালিয়েছেন ষাটের দশকে ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করে। ওই পত্রিকা ধরে উঠে এসেছেন ষাটের দশকের প্রথম সারির কবি ও লেখকেরা। পরের দেড়যুগ মেতে ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেলে শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা নিয়ে। পরিশীলিত রুচির দর্শক গড়ে তোলার পেছনে তাঁর অবদান আছে। তাঁর মূল পরিচয় শিক্ষকতা চালিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে। শিক্ষক হিসাবে স্যারের সাফল্য অগণনযোগ্য, অপরিমেয় এবং কিংবদন্তীতুল্য ! সবকিছু নিয়ে মেতে থাকায় নিজের লেখালেখির দিকে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেন নি। দেখা হওয়ার পরে সৌজন্য কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরে এখন কি কি পড়ছেন, বা লেখালেখির কি অবস্থা জিজ্ঞেস করা হলে , হাসিমুখে বললেন, ‘ শোন হে আরেকটু বেশী করে লেখালেখি করতে পারলে ওই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের ( পড়ুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কাছাকাছি পরিমাণ লিখে ফেলতে পারতাম!’ আমাদের কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘পরিমাণ বেশী হওয়াই কি সব? গুণগত মান না থাকলে পরিমাণ বেশী দিয়ে কি হবে?’ স্যার বললেন, ‘ভুলে যেও না কোয়ান্টিটি নিজেও কিন্তু একটা কোয়ালিটি।’

সত্যিই , স্যার নানা কাজে মেতে থাকায়, নিজের লেখক সত্তাকে সময় দিতে পারেননি । স্যারের আড়ালে আমি আর আরেক সতীর্থ বলে ফেললাম, লেখক সত্তার চেয়ে স্যারের শিক্ষক-সুলভ উদ্দীপক বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ড অনেক বেশী জনপ্রিয় ও কার্যকর। তা ছাড়া আরো দশজন লেখকের মতো তিনি নিজের লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমরা তাঁকে পেতাম কোথায়? তাই যা হয়েছে, বাংলাদেশের বৃহত্তম স্বার্থের জন্য ভালোই হয়েছে।

কেন্দ্রে সন্ধ্যার পর পৌঁছানোর কথা থাকলেও সবার দেরী হয়ে যায় ঢাকার ট্র্যাফিকে । প্রবাসী বন্ধুরা ঢাকার ট্রাফিকের পাশাপাশি ঢাকার যত্রতত্র ফেলে রাখা নোংরা আবর্জনা ও ঢাকার মানুষের নাগরিক আচরণ-বোধ , সিভিকসেন্সের অভাবের কথা ওঠাল। জনসংখ্যার চাপ নাকি অন্যকোন কারণে রাস্তাঘাটে মানুষের থুতু ফেলার পরিমাণ বেড়ে গেছে , কে জানে। বাঙালির সমস্যা হচ্ছে, বাইরের দেশে আমরা আইন মেনে চলি, নিজের দেশে ঠিক তার উল্টো। আমাকে বিভিন্ন দেশে অফিসের কাজে যেতে হয়। এই যাত্রাগুলোর বেশীরভাগই এমিরেট্স এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দুবাই-এ ট্রানজিট থাকে। ওই ফ্লাইটগুলোর জায়গায় এখন অনেক বাজেট ফ্লাইট এসেছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা ইদানীং এমিরেট্সের ফ্লাইট তেমন ব্যবহার করেন না। এমিরেট্স একসময় উচ্চবিত্ত , মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সবধরনের যাত্রীর প্রধান বাহন ছিল। ইদানীং উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যাত্রীদের প্রাধান্য বেশী। তো বছর পাঁচেক আগে, আমি ক্লান্ত হয়ে ঢাকার ইমিগ্রেশন পার করে লাগেজ বেল্টে এসে দাঁড়িয়েছি মাত্র। ওই ফ্লাইটের সিংহভাগ ভাগ প্রবাসী শ্রমিক। প্রতি ফ্লাইটেই আমাকে এঁদের কারো না কারো এম্বার্কেশন ফর্ম ফিলাপ করে দিতে হত।যাই হোক, লাগেজ বেল্টের কাছে এসে দেখি এক প্রবাসী শ্রমিক হুট করে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। আমি হতভম্ব ! কাছে গিয়ে বললাম, সিগারেট খাচ্ছেন কেন। তো , সে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিল। তাঁকে প্রথমে বুঝিয়ে বললাম, দুবাই এয়ারপোর্টে কোথায় সিগারেট ধরালেন না। যে কয়দিন দুবাইয়ে ছিলেন , নিয়ম মেনে চললেন ; যেই না বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছেন, সব নিয়মকানুন ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করল? আমার উত্তেজিত বাদানুবাদে এয়ারপোর্ট পুলিশ এসে পড়লে, ঘটনার ওখানেই শেষ হয়। যে শিক্ষাটা পরিবার থেকে হওয়া উচিৎ, সেটা বয়সকালে শাস্তিযোগ্য অপরাধের ভয় দেখিয়ে কতখানি সাফল্য পাওয়া যাবে। নিজের কফ থুতু নিজের ভিতরে রাখা উচিৎ। অসংখ্য জীবাণু কফ থুতুর সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে ; সেটা প্রাপ্তবয়স্কদের না বুঝিয়ে স্কুলে স্কুলে বোঝানো উচিৎ। থুতু-কফ ফেলা, যত্রতত্র মূত্রত্যাগ আমাদের বাঙালিরা বাইরে গেলে কখনই করে না ; দেশে অবলীলায় করে। জানে, নিয়ম ভাঙ্গাটাই নিয়ম। বাইরে গেলে আমিও চকলেট টফির মোড়ক আশেপাশে বিন-বক্স না পেলে পকেটে রেখে দিই, যথাস্থানে ফেলে দেওয়ার জন্য ! সেই আমিই হয়তো ঢাকার রাস্তায় যা ইচ্ছে তাই ফেলছি, কারণ এটাই নিয়ম আর সাধারণ জনগণের জন্য পাবলিক টয়লেট বা বিন-বক্স কিছুই নেই বললেই চলে।

বাঙালির আলস্য নিয়ে স্যারের ব্যঙ্গাত্মক কথা বার্তা আগেও শুনেছি, আবার শুনলাম। কেউ একজন কেন্দ্রের টয়লেটের পরিচ্ছন্নতার প্রশংসা করলে , স্যার মনে করিয়ে দিলেন এই কেন্দ্রেও বাঙ্গালীর আলস্য পৌঁছে গেছে। কাজ শেষ হওয়ার পর, সামান্য ইউরিনাল ফ্ল্যাশ করতেও এঁদের আলস্য লাগে। বাধ্য হয়ে স্যার ,পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কে বলে দিয়েছেন প্রতি ১০-১৫ মিনিট পরপর যেন টয়লেটগুলোকে ফ্ল্যাশ করার হয়।

আসলে ঢাকা শহর তো একটা বিশাল গ্রামের মতো। অন্য পুরনো শহরের মতো দীর্ঘস্থায়ী রুচিসম্পন্ন জনগোষ্ঠী এখানে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় নি। মূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে মফঃস্বলের রুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবানদের চেয়েও বেশী প্রাদুর্ভাব বিশুদ্ধ গ্রাম্য জনগণের। গ্রাম থেকে স্কুল পেরিয়ে অথবা না পেরিয়ে জীবিকার তাগিদে এক বিশাল জনস্রোত চলে আসছে ঢাকায় । তাই এই গ্রাম্য ঢাকাবাসীর নাগরিক সচেতনতা গড়ে উঠতে সময় লাগছে।

আরো কিছু বদভ্যাসের অভ্যাসের কথা উঠে এলো আলোচনায় । স্যারের আঙুল মটকানোর অভ্যাস আছে । এই বাজে অভ্যাসটা আমার ও আছে কোনভাবেই নিষ্কৃতি পাইনি। কতো জনে লজ্জা দিয়েছে, তবু যাচ্ছে না। স্যার নাকি , এটি নিয়ে কোন একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। ডাক্তার তাঁকে হতাশ করে বলেছেন, ‘ছোট বেলা হলে মুরব্বী কারো এক ধমকেই এটা সেরে যেতে পারত। এই বয়সে এখন আর সম্ভব নয়।’

এই কথার হাত ধরেই সুস্থ অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রসঙ্গে কোয়ান্টাম ও মহাজাতকের কথা এসে পড়ল। আমি নিজেও একটু অবাক হয়েছিলাম, স্যার নিজেই যেখানে বাতিঘর, তাঁর কেন কোয়ান্টাম করতে হবে। স্যারে বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপ বক্তৃতা ইউটিউবে দেখেছিলাম কোয়ান্টামের প্রশংসায়। যা বললেন , বেশ কয়েকবছর আগে তাঁর হঠাৎ করে ক্লান্তি ভর করেছিল। কোন কারণ ছাড়াই ওজন দ্রুত কমে যাচ্ছিল অথচ কোন অসুস্থতা নেই। মনে হয়েছিল, এটাই বোধহয় সেই ‘বার্ধক্য’ ! অবশেষে বার্ধক্য চলেই এসেছে। কোয়ান্টামের শহীদ আল বুখারীর সঙ্গে স্যারের পরিচয় অনেকদিনের। তিনি অনেকবার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। স্যারের স্ত্রীও কোয়ান্টামের ব্যাপারে সপ্রশংস। কি মনে করে একদিন হাজির হলেন কোয়ান্টামের অনুষ্ঠানে। প্রথমদিনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উনি বুঝে গেলেন তাঁর সমস্যটা কোথায়। আসলে জগতের সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, সুন্দর যেমন নিজের সৌন্দর্যকে দেখে না ; যেমন করে চোখ নিজে সবকিছু দেখতে পায় , কিন্তু সে নিজেকে দেখতে পায় না। মস্তিষ্কও ঠিক তেমনি সারাক্ষণ অন্যকে পরিচালনা করে চলেছে, কিন্তু তাঁকে পরিচালনা করার কেউ নেই ! মস্তিষ্কের আচরণ কিছুটা নির্বোধের মতই মনে হয়। তাঁকে যদি ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু বোঝানো যায় , সে বুঝে ফেলে। কোয়ান্টামের মূল ব্যাপারটি হয়তো তাই। স্যার ভাবা শুরু করেছিলেন, বার্ধক্য এসে গেছে, এই অটো সাজেশন ব্যাপারটিকে প্রভাবিত করছিল তাঁর শরীরে। যেই না তিনি উল্টো ভাবা শুরু করলেন ফিরে গেলেন আগের তারুণ্যে।

আমাদের প্রাত্যহিক কাজের আমনুষিক চাপ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির গড়মিল , হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ানো আর নিরবচ্ছিন্ন হতাশার জীবন। কেন এতো হতাশা চারিদিকে? জীবনের প্রাপ্তিও তো কম নয় ! তবু কেন প্রাপ্তির তুলনায় অপ্রাপ্তিকে নিয়ে আমাদের এতো হা হুতাশ। যে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রণিধানযোগ্য , সেটা হচ্ছে, আমাদের জীবনের ৯৫ ভাগই আশার মাত্র ৫ ভাগ বা তারও কম হয়তো নিরাশার। কিন্তু নিরাশার ব্যাপারটিকে নিয়ে মানুষ বেশী আলোচনা করে, সেটি মনে রাখে দীর্ঘদিন।

স্যারের সঙ্গে পরিচয় সেই ৯০ সাল থেকে। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতিতে প্রায় ২০ বছর পরে স্যারে সঙ্গে মুখোমুখি আড্ডা। স্যার সব সময় ধর্ম নিয়ে যে কোন আলোচনাকে সযত্নে এড়িয়ে যেতেন। আমার নিজের একটা ব্যাখ্যা আছে এই ব্যাপারে। সেই বছর পঁচিশেক আগেই কেন জানি মনে হয়েছিল ওই কথাটা । আসলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পড়ানো হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের লেখাগুলো –তাঁদের কেউ তো আর তথাকথিত ধার্মিক বা ধর্মগুরু ছিলেন না। আমাদের পড়তে হয়েছে চিরায়ত বিশ্বসাহিত্য থেকে শুরু করে চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের বেছে নেওয়া লেখাগুলো। ওই লেখাগুলোর কিছুটা প্রভাব আমাদের সদ্য প্রস্ফুটিত মনের উপরে পড়েছেই। ধর্মশিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের পুরো পরিবার ও সমাজ উঠে পড়ে লেগেইছিল। স্যার তাই ধর্ম অধর্ম নিয়ে নতুন করে কিছু কখনই বলেননি।

আবার মোল্লা পুরোহিতরা সারাজীবন প্রগতির বিরুদ্ধে, সকল প্রশ্নের বিরুদ্ধে। আশির দশকে সেই আশংকা একেবারে যে ছিল না , তা নয়। ওই সময়েও কোন একজন মেধাবী লেখককে বা কোন প্রতিষ্ঠানকে কোনভাবে ধর্মবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিতে পারলে তাঁর দফারফা হয়ে যেত ; সে আমাদের বহুবারের দেখা। স্যার তাই , নিখাদ সাহিত্যের বাইরে কোন কিছু বলতেন না। হতে পারে, ধর্মের মতো নির্জীব একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় তাঁর উৎসাহও ছিলনা। আলোর সংস্পর্শে এলে কাউকে আর আলাদা করে পথ দেখিয়ে দিতে হয় না । নিজের জ্বালানো আলোতে পথ খুঁজে নিতে পারবে তাঁর ছাত্ররা, সেই বিশ্বাস তাঁর ছিল। সেই সময়েও যেমন অনেক প্র্যাকটিসিং ধার্মিক লোকের আনাগোনা ছিল কেন্দ্রে। এখনো আমাদের মধ্যে বন্ধুদের মাঝে অনেক প্র্যাকটিসিং মুসলমান আছেন। কোন দ্বিধা ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের কেটে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রশিক্ষক সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে অবলীলায় এখন অনেক কথাই জিজ্ঞেস করে ফেলি আমরা। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসনামলে ধর্মীয় পাণ্ডাদের উপদ্রব ছিল। তা ছিল সীমাবদ্ধ কয়েকটি জায়গায়। পাণ্ডাদের যন্ত্রণার পাশাপাশি একটা সুস্থ, পরিশীলিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল। সাধারণের মাঝে হিজাব, বোরখার প্রকোপ বা ধর্ম নিয়ে ‘গেল গেল’ রব ছিল না। এখন প্রায় অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে এসে, ধর্মীয় পাণ্ডাদের উপদ্রব যেমনটি বেড়েছে ; প্রগতিশীলরা একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মাঝে হিজাব, পর্দার মতো ব্যাপারটা বুঝে না বুঝে ফ্যাশনের মতো জেঁকে বসেছে। আমি স্যারকে সেটাই মনে করিয়ে দিলাম, ষাটের দশকের চেয়েও ধর্মের প্রকোপ এতো বেশী কেন, এতো ধার্মিক লোক তবু কেন এতো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ? স্যার এড়িয়ে যেতে যেতে যেটুকু বললেন, তাঁর মতে বর্তমান পুরো মুসলিম সমাজ হীনমন্যতায় ভুগছে। ছোট্ট একটা দেশ ইজরাইল, ৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে সারা আরব বিশ্বকে ত্রস্ত করে রেখেছে। সারা বিশ্বে যাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী হচ্ছে ১৫ মিলিয়নের মত। সেই তুলনায় মুসলিম আছে সারা বিশ্বে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ( ১৬০০ মিলিয়ন) । স্পষ্টত: ইহুদীদের তুলনায় মুসলমান আছে প্রায় ১০০ গুণ ! কিন্তু ওই গুটিকয়েক ইহুদীদের দাপটে পুরো মুসলিম সমাজ তটস্থ । ইজরাইলও জানে, কোন মুসলিম দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র যাওয়ার মানে তাঁদের অস্তিত্ব শেষ ! একটা সুইচ , একটা বাটনে তাঁদের পিতৃভূমি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ; তাই প্রাণপণে তাঁদের চেষ্টা থাকে তাঁদের সর্বোচ্চ মেধা ও শক্তি দিয়ে মুসলিম সমাজকে পারমাণবিক শক্তিমত্তা থেকে দুরে রাখা। এই এক অস্তিত্বের সংকটের দোটানায় নানা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে। মুসলিম সমাজ বলেই নয়, যখনই একটি সমাজের মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে সে বেশী করে তাঁর পুরনো বাতিল হয়ে যাওয়া কৃষ্টি, সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে। বেশী করে মুসলমানিত্ব দেখানো, হিজাব এবং এর সঙ্গে উপজাত হিসাবে সন্ত্রাসবাদের কারণ ঘুরে ফিরে সেই ইজরায়েলের সঙ্গে না পেরে ওঠার হীনমন্যতা।

আমাদের অনেকে চলে গেছি কোন দূর প্রান্তে। জীবিকার নিষ্পেষণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের খোঁজ খবর রাখার সময় হয়ে ওঠে না। অনেকে যোগাযোগ রাখতে চায়; কেন্দ্র ছেড়ে যেতে চায় না। কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে কতশত নতুন ছেলেমেয়ের মুখ আসে প্রতিবছর। পুরনোদের আর প্রয়োজন নেই। স্যার মনে করিয়ে দিলেন, বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরনোর পর স্কুল পার হওয়ার পর, কেউ কি ইচ্ছে করলেই স্কুলে ফিরে আস্তে পারে ? কেউ যদিও আসে, সেটা হবে মর্মান্তিক ও হাস্যকর। কেন্দ্রকে , স্যার কে যখন আমাদের প্রয়োজন ছিল, আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল , এখন আর নেই। আমাদের আর কেন্দ্রে ফিরে আসার দরকার নেই, আমরা ব্রাত্য হয়ে গেছি। স্যার অনেকবার বলেছেন গুরু দ্বিবিধ হয়, একধরনের গুরু শিষ্যকে এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে ; এক পর্যায়ে দেখা যায় গুরু ছাড়া শিষ্য শ্বাসপ্রশ্বাসও নিতে পারছে না। আরেক ধরণের গুরু আছেন, যারা শিষ্যদেরকে এমনভাবে সময় দেন , তৈরি করেন , এক পর্যায়ে শিষ্যরা নিজের ডানায় উড়তে পারে। স্যার সম্ভবত: অথবা সেই দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষক যাঁদের শিষ্যদের ডানায় ওড়ার জন্য গুরুর দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। কেন্দ্রের অনেক পুরনো ছাত্ররা তাঁদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে নি। আব্দুন নুর তুষার সম্পর্কে স্যার সেই কথাই বললেন। এতো বহুমুখী প্রতিভা নিয়েও কোন একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তুষার ভাই মনোযোগ দিতে পারেন নি।

আগের বারেও স্যারের সঙ্গে যখন কথা হয়েছে, স্যার বলেছেন তিনি একসঙ্গে ১০-১২টি বিভিন্ন ধরণের, বিভিন্ন লেখকের বই পড়া শুরু করেন। এই বছরে এসে স্যার সেটা পরিবর্তন করেছেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এটা একজন লেখকের প্রতি অন্যায়। যে কোন একজন লেখকের লেখা একটি সময়ে মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিৎ। অনেকগুলো লেখকের লেখা একসঙ্গে পড়লে, কোন একজন নির্দিষ্ট লেখকের লেখাকে সেইভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। আমিও এই ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখলাম, আসলেই তো।

বেঁচে থাকা নিয়ে তীব্র আশাবাদ স্যারের সবসময় ছিল, তা এই দুই আড্ডায় নতুন করে আবার উঠে এলো। মহাকালের প্রেক্ষিতে এই মহাবিশ্ব আমার কাছে কি বা আমি মহাকালের কাছে কতখানি তুচ্ছাতিতুচ্ছ সেটার চেয়েও বড় ব্যাপার আমি নিজে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের একটা অংশ হতে পেরেছি। উদাহরণ দিলেন , যে আকাশকে এই মুহূর্তে আমি দেখছি, সেটা আমার আকাশ !

দিন দশেক পরেই দ্বিতীয় আড্ডায় যেতে যেতে যথারীতি দেরী। স্যার কিছু কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের একজন বলে আসল, আমরা কেন্দ্রের ক্যাফেটেরিয়া বা ক্যান্টিনে থাকছি। কিছুক্ষণ পরে হাতের কাজ সেরে স্যার হাজির হলেন আমাদের চলতি আড্ডায় । কেউ কেউ লেখালেখি করছে, অনেকেই করছে না। আবার আমাদের ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমেই সবার যোগাযোগ রক্ষা। হুট করে আমাদের আলোচনা মোড় নিলো ফেসবুকে। কে কিভাবে নিজেকে প্রকাশিত করে, সেটা নিয়ে।

স্যারের সোজা কথা, ফেসবুক মানুষকে অস্তিত্বের সংকট ও আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকে মুক্তি দিয়েছে। রাস্তায় বের হলে, আমি আর তুমি সবাই তো একেকটা পোকামাকড়ের চেয়ে বেশী কিছু না। সেই আমাকে ফেসবুক সুযোগ দিয়েছে, নিজের আলাদা একটা পরিচয় তুলে ধরতে। সুশ্রী ছবি, চলতি হাওয়ার মুচমুচে বক্রোক্তি এনে দিচ্ছে লাইক, কমেন্টস। আমি যে কেউ সেটার একটা স্বস্তি অনুভূতি এনে দেয় ফেসবুক। কিন্তু সাময়িক স্বস্তির ফেসবুক মূলত: অস্থির সময়কে আরো অস্থির করে তোলে। যারা লেখালেখি করতে চায়, তাঁদের ফেসবুক থেকে দুরে থাকাই ভালো। বড় কিছু , গভীর কিছু পেতে হলে স্বল্পমেয়াদী ফেসবুকের লাইক ও আত্মপরিচয়ের স্বস্তির জায়গা থেকে সরে আসা ভাল।

আমাদের নিজেদের অনেক গল্প জমে ছিল। স্যার যখন ক্যান্টিনে এসে আমাদের সঙ্গে বসলেন, আমাদের কথার ফাঁকে স্যারকে কথা বলতে হচ্ছিল। একটা সময় ছিল, সারাক্ষণ তাঁর কথা শোনার জন্য আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতাম। সময়ের প্রেক্ষিতে আমাদের বয়স হয়েছে। আমাদের নিজেদের গল্প হয়েছে। আমাদের লেখিকা বন্ধু , যে একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী , গৃহিণী, মা ও পরিবারের অংশ। তাঁর মুশকিল হচ্ছে, সে ফেসবুকে যাই লেখে না কেন সেটা নিয়ে তাঁকে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়ে, কে কি ভাবল। প্রেমের কবিতা লিখলে স্বামী বেচারা না ভেবে বসে, তাঁর কবি স্ত্রী আবার নতুন করে প্রেমে পড়ে গেল কিনা ! কোন অপছন্দের কথা, কোন তীব্রতার কথা লিখতে গেলে তাঁকে ভাবতে হয়– এতো ছাত্র ছাত্রী আছে ; তাঁরা এটাকে কিভাবে নেবে। এমনও হয়েছে, সে একটা লেখা লিখে আবার অস্বস্তি থেকে মুছেও ফেলেছে।

লেখিকা বন্ধু আমার ফেসবুকের লেখালেখির অকপটতাকে সাধুবাদ জানালো। কারণ আমি অনেক কিছু লিখে ফেলি হুট করে। আজ পর্যন্ত, কোন লেখা আমাকে মুছতে হয়নি। হতে পারে পুরুষ-শাসিত সমাজে এটা আমদের একটা প্রিভিলেজ। আবার আমার লেখার বিষয় কবিতা বা গল্প নয়। আমি নিতান্তই কর্পোরেট অব্জার্ভেশন বা টুকটাক স্মৃতিচারণ করি। সেই অর্থে আমার পরিবারের , সমাজের বা আমার বন্ধু-তালিকার বন্ধুদের প্রতি আমি তেমন কোন দায়বদ্ধতা বোধ করি না ।
আমার মুখোমুখি একজন বন্ধু বসে থাকলে, তাঁর সঙ্গে যৌনতা নিয়ে যেভাবে কথা বলতে পারি। ফেসবুকে হয়তো সামান্য শালীনতা রেখে বলি; কিন্তু বলি , কোন দ্বিধা ছাড়াই বলি।

লেখালেখির ব্যাপারে স্যারের মন্তব্য ছিল, লেখকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার সীমারেখা অতিক্রম করেই মাঝে মাঝে লিখতে হয়। নতুবা আবুল কালাম আজাদের মতো লিখে রেখে বলে যেতে হবে , মৃত্যুর ২৫ বছর পরে যেন তা প্রকাশিত হয় ! সারাক্ষণ পাঠকের কথা ভেবে লিখতে গেলে সেটা ‘নিজের’ লেখা হবে না। ঠিক এই ব্যাপারটাই আমাকে ফেসবুক থেকে দুরে ঠেলে দেয়। এখানে পাঠক ও বন্ধুদের একটা এক্সপেকটেশন থাকে।সারাক্ষণ নিজের সামাজিক অবস্থানের কথা , পরিবারের কথা, অফিসের কথা চিন্তা করতে হয় ; সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাল্যান্স করে, সবাইকে নাখোশ না করে, খুশী করে লিখতে গেলে নিজস্বতা থাকে না।

স্যারের উপস্থাপক জীবনের কথা উঠতেই , উনি অকপটে স্বীকার করলেন, এতগুলো পরিচয়ের মধ্যে, টিভি উপস্থাপনার সময়কে উনি সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছেন। প্রায় আশির দশক পর্যন্ত বিটিভি নিয়ে মেতে ছিলেন তিনি। আমাদের সৌভাগ্য হয়নি স্যারের সেই সময়ের অনুষ্ঠান দেখার। কিছু আর্কাইভ ছিল, কিন্তু কোন এক মহাপরিচালকের নির্বুদ্ধিতায় সপ্ত ডিঙ্গার সব রেকর্ডগুলোকে পুনঃ ব্যবহার করা হয়েছিল। মানে, পুরনো ফিতে মুছে তার উপরে আবার নতুন অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছিল ! তাই কোন স্মৃতি আর অবশিষ্ট নেই। আমাদের প্রজন্ম কিছুটা পেয়েছি তাঁকে আশির দশকের ঈদ আনন্দমেলায় সামান্য কয়েক মিনিটের অতিথি হিসাবে। অবশ্য কয়েক মিনিটের উপস্থিতিতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দর্শককে বুঝিয়ে দিতেন , কেন তিনি অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রম।

কেন টিভি ছেড়ে দিলেন, সেটা স্যার স্মৃতিচারণে লিখে গেছেন। আবারো বললেন। তিনি মূলত: শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই সাদামাটা পাঞ্জাবী পায়জামা পড়তেন। টিভির কোন এক অনুষ্ঠানে প্রয়োজনের খাতিরেই তিনি হালকা কারুকাজ করা নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়েছিলেন। পরেরদিন ঢাকা কলেজে গেলে একজন অভিমানী ছাত্র তাঁকে আলাদা ডেকে তাঁর পোশাকের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিল। ছাত্রটি মনে করিয়ে দিয়েছিল , স্যারের জায়গা সব ছাত্রের কাছে অনেক উঁচু স্থানে ; আর দশজন মিডিয়া কর্মীর মত নয়। স্যার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেন , বললেন দুইদিক রক্ষা করে চলতে হয় তাঁকে। ছাত্রটি নাকি বলেছিল, তাহলে আমাদের কাছে আসার দরকার নেই, আপনি ওই জগতেই থাকেন। এই ঘটনা স্যারকে টিভি ছেড়ে দেওয়ায় প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তী সময়টুকু তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দিয়েছেন অধ্যাপনায়, লেখালেখি ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তোলায়।

ওই সময়ের টিভি অনুষ্ঠানের মান আর এই সময়ে অনুষ্ঠানের মানের কথা উঠলে, আমরা এক কথায় সায় দিলাম , সত্তুর আশির দশকের টিভি অনুষ্ঠানের মান অনেক ভালো ছিল। সাদাকালো টিভি বলেই নয়, টিভি সবসময় ইন্টেলেকচুয়ালদের জায়গা। এখানে, সুন্দর বা সুন্দরী হতেই হবে ; রঙচঙে পোশাক পড়তেই হবে তা নয়। উপস্থাপক যদি তাঁর বাগ্মিতা দিয়ে দর্শককে মুগ্ধ করতে পারে, তাঁর পোশাক ও চেহারা ধর্তব্য হয় না। সেই সময়ে অমানুষিক পরিশ্রমের কথা ভেবে শিউরে উঠলেন স্যার। প্রতি সপ্তাহে ৭৫ মিনিটের অনুষ্ঠান করা, নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে, চাট্টি খানি কথা নয়।

ঘুরে ফিরে লেখালেখির প্রসঙ্গ চলেই আসে। লেখক হচ্ছে দুই জাতের ; এক জাতের লেখক আছেন যারা লেখক হয়েই জন্মেছেন, প্রথম লেখা থেকেই লেখক। কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম জাতের লেখক। আরেক জাতের লেখক আছেন, যারা লিখতে লিখতে লেখক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ দ্বিতীয় জাতের লেখক। স্যারের ‘ বিস্রস্ত জর্নাল’– বইটি গত বছরে পরিবর্ধন ও সংশোধন করেছেন। এইবার ও নাকি করবেন। আমি যেহেতু স্যারে প্রবন্ধের সব বই কিনে নিজের সংগ্রহে রাখি ; আমাকে ওই বইটা আবার কিনতে হবে দেখে কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করলাম। বললাম , এর শেষ কোথায়? প্রতিবছর একই বই সংশোধন ও পরিবর্ধন করলে আমাদের মতো পাঠকের প্রতিবারই কিনতে হবে অথবা আমরা বঞ্চিত হয়ে থাকব সর্বশেষ লেখাটি থেকে। স্যার মনে করিয়ে দিলেন , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিটা লেখায় অনেক কাটাকাটি করতেন। লেভ তলস্তয় ‘ ওয়্যার অ্যান্ড পিস’ নামের বিশাল কলেবরের বইটি নাকি ১২ থেকে ১৩ বার পুনর্লিখন করেছিলেন। নিজের লেখায় তৃপ্তি না আসা পর্যন্ত উনি পরিমার্জন করে গেছেন। হয়তো সেই কারণেই ওই মহা কাব্যিক লেখা আজ আমাদের সামনে মহীরুহের সম্মান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি জীবনানন্দের কয়েকটি কবিতার কথা বললাম, যেটি জীবনানন্দ কয়েকবার পুনর্লিখন করেছেন। আমার কাছে প্রতিটা কবিতার শব্দচয়ন ভালো লেগেছে। কারণ তাঁর শব্দ চয়ন এতো সুন্দর এতো কাব্যিক, যাই লিখেছেন প্রতিবার সেটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। জীবনানন্দ একটা কবিতা হয়তো কোন ছোট পত্রিকায় লিখেছেন। ছাপা অক্ষরে দেখার পরে নিজে থেকেই মনে হয়েছে, ঠিক হয়নি। উনি আবার পরিমার্জন করেছেন। অবশেষে কাব্যে হিসাবে প্রকাশ করার আগে আরো একবার পরিমার্জন করেছেন। এতো গভীর পরিশ্রমের পরেই এসেছে ওই অদ্ভুত ভালোলাগার কবিতার লাইনগুলো।

স্যার, নিজের লেখা পরিমার্জনের স্পৃহাতে নাখোশ নন। তাঁর বক্তব্য চলমান জীবন্ত লেখকেরাই লেখা পরিমার্জন করে চলেন। মৃত লেখকদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

তলস্তয় নাকি শেক্সপিয়ারের রচনা ভালভাবে বোঝার জন্য ইংরেজি ভাষা শিখেছিলেন। শেক্সপিয়ার পড়ে তলস্তয় বলেছিলেন শেক্সপিয়ারের রচনার দশ লাইন পরেই নাকি অযৌক্তিক কথা এসে পড়ে। উনি এগারো লাইনও যুক্তি ধরে রাখতে পারেননি। শেষ বয়েসে তলস্তয় বুঝতে পেরেছিলেন , মানুষের পক্ষেও বেশীক্ষণ যুক্তি দিয়ে কথা বলা সম্ভব না। নির্দিষ্ট সময় পর পর অযৌক্তিক কিছু এসেই যায়।

মৃত্যু ও বার্ধক্যের প্রসঙ্গ চলে আসে আমাদের আলোচনায়। দ্রুত অতিক্রান্ত সময়ে আমাদের সামনে অবধারিত ভাবে বার্ধক্য সঙ্গী হিসাবে ও মৃত্যু আতঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে । কীভাবে এর সঙ্গে বসবাস করতে পারব। স্যার বার্ধক্যের গুণকীর্তন করেছেন আগের অনেক বক্তৃতায়। আজও করলেন, আমাদের একজনকে দেখিয়ে বললেন, আমি তো তোমাদের লক্ষ্য , তোমাদের পরিণতি। তোমরা তো আমার এই বয়েসে এসে আমার মতোই হতে চাও। যা তোমরা হতে চাইছ, আমি তাই। সুতরাং বার্ধক্য নিয়ে তাঁর কোন হুতাশন নেই।

প্রিয়জন হারানোর বেদনা, মৃত্যুর বেদনা আমাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এঁর সঙ্গে কিভাবে সহাবস্থান সম্ভব ? আসলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বেদনাবোধ কমে না, হয়তো বাড়তেই থাকে, কিন্তু তাকে মেনে নেওয়ার সহনশীল হওয়ার একটা প্রাপ্তবয়স্কতা চলে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান।” যখন লিখেছিলেন ভানু সিংহের পদাবলী ছদ্মনামে, তখন তিনি নিতান্তই যুবক। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মৃত্যুর হাহাকার নিয়ে কথা বলার বয়সতো সেটি ছিল না। তবে কেন তিনি হাহাকার করেছেন? বরং বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ওই হাহাকার যথোপযুক্ত ছিল। মূলত: বয়সের সঙ্গে সহনশীলতা বেড়ে গেছে, মেনে নেওয়ার , অভিযোজনের ক্ষমতা বেড়ে গেছে বলেই প্রৌঢ়ত্বে মৃত্যু নিয়ে কোন ভাবালুতা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় কত কথা অব্যক্ত রয়ে গেল। কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটা বা বারোটা বেজে গেলে উঠে পড়তেই হয় যার যার গন্তব্যে।ফিরতি পথ জুড়ে ভালোলাগার রেশ থেকে যায় সবার মাঝে।

সবাইকে ২০১৭ সালের ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা !

প্রকাশকালঃ ডিসেম্বর,২০১৭